পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯০
আত্মচরিত

 মিঃ র‍্যামজে ম্যাকডোনাল্ড এইভাবে তাঁহার প্রথম জীবনের বর্ণনা করিয়াছেন (২৬শে নবেম্বর, ১৯৩১ তারিখে প্রদত্ত বক্তৃতা):—“অতীত জীবনের ঘটনা স্মরণ করিলে বিস্মিত হইতে হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে লসিমাউথের জনৈক বৃদ্ধা ধীবররমণী আমাকে দেখিয়া তাহার সরল সহানভূতিপূর্ণ স্বরে বলিয়াছিল—‘জিমি, পৃথিবীতে এমনই আশ্চর্য ঘটনা ঘটে!’”

 “জীবনের সহজ সুগম সদর রাস্তা দিয়া না গিয়া যদি দুর্গম কর্দমাক্ত সঙ্কীর্ণ পথে চলা যায়, তবে মানব জীবনের সুখ দুঃখ, উন্নতি অবনতি, ত্যাগ ও আনন্দ, সব অবস্থারই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ হয়।”

 মিঃ ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার বাল্য স্মৃতি হইতে দুইটি ঘটনার উল্লেখ করেন। “শীতের প্রভাত, তুষার পাত হইতেছে। অন্ধকার থাকিতে আমরা উঠিয়াছি এবং তুষারাবৃত পথে প্রায় এক মাইল পদব্রজে গিয়াছি। আমরা একটি আলুর ক্ষেতে গেলাম। সেখানে যন্ত্রযোগে মাটীর নীচ হইতে আলু তোলা হইতেছে, আমি একটি ঝুড়িতে আলু সংগ্রহ করিতেছি। দুই হাত তুষার-হিম হইয়া গিয়াছে, চোখের জল রোধ করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। আমাদের সকলের উপরে যে সর্দার সে আমার কাছে আসিল, আমার তুষার-হিম কর্ণমূলে চপেটাঘাত করিল। সেই কথা স্মরণ করিতেই এখনও যেন আমি শরীরে বেদনা বোধ করি। অনেক সময় পার্লামেণ্টে গবর্ণমেণ্টের পক্ষীয় সম্মুখের আসনে বসিয়া ঐ অতীত কাহিনী এখনও আমার মনে ভাসিয়া আসে।”

 মিঃ ম্যাকডোনাল্ড তাঁহার বাল্যস্মৃতিতে একজন সেকেলে লোকের কথা বলিয়াছেন। তিনি লসিমাউথের রাস্তায় ঠেলাগাড়ীতে ফেরী করিয়া বেড়াইতেন। “তাঁহার গাড়ীর সম্মুখে এক খণ্ড ট্যাসিটাসের বই থাকিত। তিনি লাটিন ও গ্রীক বই পড়িতেন আর সঙ্গে সঙ্গে জিনিষের নাম হাঁকিতেন। একদিন তিনি আমার হাতে একখানি বই দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি এ সব পড়িতে ভালবাস?’ এবং আমার হাতে একখানি হেরোডোটাসের ইতিহাস দিলেন। পরে কয়েকমাস যাবৎ তিনি আমাকে আরও কতকগুলি বই দিয়াছিলেন।”

 আর একজন শ্রমিক নেতা জর্জ ল্যান্সবেরী সম্প্রতি (ডিসেম্বর, ১৯৩১) তাঁহার বাল্যজীবনের কথা এবং কিভাবে তাঁহাকে কঠোর জীবনসংগ্রাম করিতে হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। দুই একটি স্থান উদ্ধৃত করিতেছি।

 “আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুতর ঘটনা (রাজনৈতিক ব্যাপার ব্যতীত) ১৮৮৪-৮৫ সালে ঘটে। সেই সময়ে আমি স্ত্রী, ৪ বৎসরের কম বয়স্ক তিনটি শিশু এবং ১১ বৎসরের কম বয়স্ক একটি ছোট ভাইকে সঙ্গে লইয়া দেশ ছাড়িয়া অস্ট্রেলিয়াতে যাত্রা করি।

 “অবশেষে একটা পাথর ভাঙ্গার কাজ আমি পাইলাম; একরকম নীল রঙের গ্র্যানাইট পাথর—উহাতে যখন হাতুড়ী পিটাইতাম, তখন মনে হইত আমার হাতের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ও বুঝি ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে।


 “পরে পার্সেল বিলি করিবার জন্য পিয়নের কাজ পাইলাম। তারপর যত দিন আমি অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম, ঐ কাজই করিতাম, আমার বেতন ছিল সপ্তাহে পাঁচ শিলিং, ব্রিসবেন হইতে পাঁচমাইল দূরে টুঅং নামক স্থানে থাকিবার জন্য একটি বাড়ীও পাইলাম।