পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
১৯৩

অনিষ্টকর ব্যবস্থা নাই। মাতৃভাষাই সব সময়ে শিক্ষার বাহন হওয়া উচিত। এই স্বতঃসিদ্ধ সহজ সত্য ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। একজন ইংরাজ বা স্কচ বালক ডিকেন্সের Child’s History of England, স্কটের Tales of a Grand father, Gulliver’s Travels অথবা Alice in Wonderland গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়ে। তাহার পিতামাতার নিকট হইতেও সে অনেক বিষয় শিখে। সে ভ্রমণ বৃত্তান্ত, উত্তর মেরুর অভিযানের বিবরণ, কিলিমানজারো, আণ্ডিস অথবা হিমালয় পর্বত শিখরে আরোহণের কাহিনী সাগ্রহে পড়ে, তাহার নির্দিষ্ট পাঠ্য পুস্তকে এ সব নাই, একথা তাহাকে বলিয়া দিতে হয় না। একজন ইংরাজ বালককে প্রথমে পারসী, চীনা, জার্মান অথবা রুশীয় ভাষা শিখিয়া, তাহার মধ্য দিয়া অন্যান্য বিষয় শিখিতে হইতেছে, এরূপ ব্যাপার কেহ কল্পনা করিতে পারেন কি? কাহারও নানা বিষয়ে জানা শোনা আছে, এরূপ বলিলে বোঝা যায় না, কোন্ ভাষার সাহায্যে সে ঐ সব বিষয় শিখিয়াছে। আমরা অন্ধ ভাবে একটা অনিষ্টকর ব্যবস্থা অনুসরণ করিতেছি, এবং ইহার ফলে আমাদের ছেলেদের যথার্থ শিক্ষা ও জ্ঞানলাভে প্রবল অন্তরায় সৃষ্টি হইতেছে।[]

 প্লেটো, হেগেল ও কাণ্ট, কনফিউসিয়াস্ ও মেনসিয়া, বাইবেল ও কোরান, রামায়ণ ও মহাভারত—এখনও প্রায়ই লোকে অনুবাদের সাহায্যে পড়ে। ভাষাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিত ব্যতীত কেহ মূল ভাষায় গ্রন্থ পড়িবার জন্য গ্রীক, জার্মান, চীনা, হিব্রু, আরবী বা সংস্কৃত শিখে না। এমন কি হিন্দুরাও সাধারণতঃ রামায়ণ মহাভারত তুলসীদাস, কৃত্তিবাস ও কাশীরামের অনুবাদের মধ্য দিয়া পড়ে। কিন্তু ভারতে আমরা একটা কৃত্রিম অস্বাভাবিক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছি এবং তাহার জন্য শাস্তিভোগও করিতে হইতেছে।

 ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটীগণিত, স্বাস্থ্যতত্ত্ব, প্রাথমিক বিজ্ঞান এবং অর্থনীতি বাংলা ভাষার মধ্য দিয়াই অনায়াসে শিখানো যাইতে পারে। ইংরাজীকে দ্বিতীয় ভাষার পর্যায়ে রাখা উচিত।

 যাহারা পণ্ডিত হইতে ইচ্ছা করে, তাহারা কেবল ইংরাজী নয়, জার্মান ও ফ্রেঞ্চও শিখিবে। তবে ইংরাজীকে কোন ক্রমেই শিক্ষার বাহন করা উচিত নয়। শিক্ষিত ব্যক্তিকে মোটামুটি সমস্ত বিষয়ের সাধারণ জ্ঞান লাভ করিতে হইবে এবং মাতৃভাষার সাহায্যেই


  1. বহির এই অংশ ছাপিতে দিবার সময় Report of the Matriculation Regulations Committee ((June, 1932) আমার হাতে পড়ে। উহাতে দেখিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রস্তাব গ্রহণ করিয়াছেন যে, ম্যাট্রিকুলেশনে ইংরাজী ব্যতীত অন্যান্য সমস্ত বিষয় মাতৃভাষার সাহায্যেই শিখাইতে হইবে, সতরাং এই অধ্যায়ে আমার বিবৃত যুক্তিগুলি মাত্র ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে গণ্য হইতে পারে। কিন্তু আমি দেখিয়া হতাশ হইলাম যে নূতন নিয়মাবলীতে, একদিক হইতে যে সুবিধা দেওয়া হইয়াছে, অন্যদিক হইতে তাহা কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে। দুরূহ বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিবার কঠোর পরিশ্রম ছেলেদের মস্তিষ্ক এখনও ভারাক্রান্ত করিতে থাকিবে। বস্তুতঃ ইংরাজীকে এত বেশী প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে যে তাহার জন্য তিনটি প্রশ্নপত্র নির্দিষ্ট হইয়াছে। অথচ ইতিহাস ও ভূগোলের ন্যায় প্রয়োজনীয় বিষয়ের জন্য মাত্র একটি করিরা প্রশ্নপত্র থাকিবে। গণিতের জন্য একটি এবং মাতৃভাষার জন্য দুইটি করিয়া প্রশ্নপত্র থাকিবে। সুতরাং ইংরাজীর জন্য যেরূপ মনোযোগ দেওয়া হইবে, তাহার মাত্র ষষ্ঠ অংশ ইতিহাস বা ভূগোলের জন্য দেওয়া হইবে এবং অন্য সমস্ত বিষয়ের ক্ষতি করিয়া ইংরাজীর জন্যই ছেলেদের অতিরিক্ত পরিশ্রম করিতে হইবে। তা ছাড়া, এইভাবে শিক্ষিত হইয়া ছাত্রেরা জীবন সংগ্রামে দাঁড়াইতে পারিবে না, কেন না সেজন্য প্রয়োজন সাধারণ ও সহজ জ্ঞান, কোন বিশেষ ভাষায় পারদর্শিতা নহে। মোটের উপর, বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীর যে সব দোষ ও ত্রুটী তাহা বরং কোন কোন দিকে বেশী হইবে। মিঃ মোনাহানের ভাষার এই রিপোর্ট সাম্রাজ্যবাদের ভাবের দ্বারা অত্যধিক প্রভাবান্বিত হইয়াছে।