পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
১৯৫

উপাধি লাভের জন্য ২৩০ জন ছাত্র সময় ও শক্তি ব্যয় করিবে কেন? তাহাদের জ্ঞান পল্লব-গ্রাহিতার নামান্তর। সুতরাং একজন ইংরাজীর এম, এ, লোকের নিকট উপহাসের পাত্র হইবে, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। ঢাকা শিক্ষক ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ মিঃ ওয়েষ্ট, কৃষি কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্য দিবার সময় বলিয়াছেন,—“একজন এম, এ-র ইংরাজী পাঠের ক্ষমতা ১৫ বৎসরের ইংরাজ বালিকার সমান, একজন বি, এ-র ১৪ বৎসরের ইংরাজ বালিকার এবং একজন ম্যাট্রিক পাশের ১০ বৎসরের ইংরাজ বালিকার সমান।”

 মিঃ ওয়েষ্ট অজ্ঞাতসারে কিছু অতিরঞ্জন করিয়া থাকিতে পারেন। কিন্তু একজন সাধারণ গ্রাজুয়েটের সম্বন্ধে তাঁহার কথা মোটের উপর সত্য।

 ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে মেকলে তাঁহার ইতিহাসপ্রসিদ্ধ রিপোর্টে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তন সমর্থন করেন—প্রতীচ্যবাদী এবং প্রাচ্যবাদীদের মধ্যে যে তর্ক বিতর্ক চলিতেছিল, মেকলের রিপোর্টে তাহার অবসান হয়।[] মেকলেকে এজন্য নিন্দা করা হইয়া থাকে। বলা হইয়া থাকে যে, তিনি মাতৃভাষার দাবী উপেক্ষা করেন। ইহা ন্যায্য সমালোচনা বলিয়া বোধ হয় না। কেননা মেকলে নিজেই দূরদৃষ্টিবলে বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, ভারতবাসীরা পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করিয়া মাতৃভাষায় গ্রন্থ লিখিয়া পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান দেশবাসীর মধ্যে প্রচার করিবে।[] তাঁহার ভবিষ্যৎ বাণী সফল হইয়াছে। মেকলের


  1. বর্তমান সময়ে মেকলের রিপোর্টের যে অংশ আপত্তিজনক বলিয়া গণ্য হয়, তাহা এই—“প্রধান প্রশ্ন এই যে, কোন ভাষা শিক্ষা করা সর্বাপেক্ষা লাভজনক?....... প্রাচ্য বিদ্যার মূল্য সম্বন্ধে আমি প্রাচ্য-তত্ত্ববিদদের মতই গ্রহণ করিতে প্রস্তুত। আমি একজনও প্রাচ্য তত্ত্ববিদ দেখি নাই যিনি অস্বীকার করিতে পারেন যে, কোন ভাল ইয়োরোপীয় লাইব্রেরীর এক আলমারী বই, ভারত ও আরবের সমস্ত দেশীয় সাহিত্যের সমতুল্য।...... আমি মনে করি যে, এ দেশের অধিবাসীরা ইংরাজী শিখিবার জন্য ব্যগ্র, সংস্কৃত বা আরবী শিখিতে তাহারা ইচ্ছুক নহে।”—Minute by Macaulay, 2nd Feb., 1935.
     “সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু শাস্ত্রের পক্ষপাতী হইবেন, এরূপ আশা করা যায়। কিন্তু তিনি রামমোহন, এমন কি মেকলে অপেক্ষাও তীব্র ভাষায় বেদান্তের নিন্দা করিয়াছেন। ১৮৫৩ সালে কাউন্সিল অব এডুকেশানের নিকট তিনি যে পত্র লিখেন তাহাতে আছে—“কতকগুলি কারণে আমরা এক্ষণে সাংখ্য ও বেদান্ত শিক্ষা দিতে বাধ্য হইতেছি। বেদান্ত ও সাংখ্য যে মিথ্যা দর্শন শাস্ত্র তাহাতে এখন আর সন্দেহ নাই।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—বিদ্যাসাগর)
     বস্তুতঃ, রামমোহন ও বিদ্যাসাগর নিজেরা সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী হইলেও, স্বজাতির মনকে প্রাচীন প্রথা ও সংস্কারের মোহ হইতে মুক্ত করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া ছিলেন। এই শাস্ত্র-দাসত্ব হিন্দুর মনের উপর এতকাল পাথরের মত চাপিয়া বসিয়াছিল। এই দুই মহাপুরুষের উদ্দেশ্য ছিল যে, কেবলমাত্র সংস্কৃত ও পারসী শাস্ত্র ও সাহিত্যের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ না থাকিয়া, আমাদের সাহিত্য পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের দ্বারা প্রভাবান্বিত হইবে। রামমোহন বেশ জানিতেন যে, তাঁহার স্বদেশবাসীরা যদি জ্ঞান লাভ করিতে চায় তবে মাতৃভাষাকেই শিক্ষার বাহন করিতে হইবে। এই কারণে তিনি একখানি বাংলা সংবাদ পত্র (সংবাদ কৌমুদী ১৮২১) পরিচালনা করিতেন, এবং সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে, একখানি বাংলা পুস্তিকা লিখিয়াই তিনি আন্দোলন আরম্ভ করেন। বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ সুপরিচিত গ্রন্থ মূল ইংরাজী হইতে অনুবাদ এবং উহার ভাষা বাংলা রচনার আদর্শ। রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরকেই লোকে বাংলা গদ্যের জনক বলিয়া গণ্য করে।
  2. কেহ কেহ প্রস্তাব করিয়াছেন যে, গ্রন্থকারগণকে পারিশ্রমিক দিয়া তাঁহাদের দ্বারা দেশীর ভাষায় পুস্তক লিখাইতে হইবে। মেকলে এ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন:—
     “৪। ৫ জন বেতনভুক লোক দ্বারা সাহিত্যসষ্টির চেষ্টা, কোন দেশে কোন কালে সফল হয় নাই, হইবেও না। ভাষা ক্রমে বিকাশ লাভ করে, উহা কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা যায় না। আমরা এখন