পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
১৯৭

বিষয় শিখিবার জন্য বাধ্য করা উচিত হয় নাই। উহা একটি মারাত্মক ভুল হইরাছিল এবং উহার একমাত্র কারণ সরকারী চাকরী পাইবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ১৮৬০ সালে জেকোস্লোভাকিয়াতে শিক্ষিত সমাজের মানসিক অবস্থা অনেকটা এইরূপ ছিল। “ম্যাসারিকও একটি প্রসিদ্ধ জার্মান রচনাভঙ্গী শিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি যে এত আগ্রহের সঙ্গে জার্মান ভাষা শিক্ষার দিকে মন দিয়াছিলেন, উহা কতকটা তাঁহার প্রকৃতি বিরুদ্ধে বলিয়া মনে হইতে পারে, কেন না, অন্য দিকে আবার ‘জেক’ জাতীয় ভাব তাঁহার মধ্যে বাড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু, ইহার মধ্যে বস্তুতঃ বিরোধ কিছুই নাই। জেক ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হইত না। কেবলমাত্র সাধারণ কথাবার্তায়, বিশেষতঃ দরিদ্র ও অশিক্ষিতদের মধ্যে এই ভাষার ব্যবস্থা ছিল। ম্যাসারিককে যদি শিক্ষিত সমাজের নিকট কোন কথা নিবেদন করিতে হইত, তবে জার্মাণ ভাষার আশ্রয় লইতে হইত,—সমগ্র বোহিমিয়া ও মোরেভিয়া দেশে এই জার্মান ভাষা প্রচলিত ছিল। অনেকেই তখন ভাবিতে পারেন নাই যে, উত্তরকালে এই জার্মান ভাষা শিক্ষার ফলেই, ‘জেক’ জাতি তাহাদের মাতৃভাষাতেই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় সক্ষম হইয়াছিল।” (প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিক―জীবনচরিত)

 মিঃ ওয়েষ্ট তাঁহার Bilingualism গ্রন্থে (বিশেষভাবে বাংলাদেশ সম্বন্ধে) এই বিষয়টি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছেন। তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত হইল।

 “যে দেশের বিদ্যালয়ে দুইটি ভাষা শিখিতে হয় এবং যে দেশে মাত্র একটি ভাষা শিখিতে হয়, এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। শেষোক্ত দেশে, যে অল্পসংখ্যক ছেলেমেয়ের ভাষা শিক্ষার প্রতিভা আছে, অথবা ঐশ্বর্য ও অবসর আছে, কেবল তাহারাই স্বেচ্ছায় কোন বিদেশী ভাষা শিখে; পক্ষান্তরে, প্রথমোক্ত দেশে (দ্বৈভাষিক দেশে) প্রত্যেক সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, এমন কি তার চেয়েও নিকৃষ্ট ছেলেমেয়েকে বাধ্য হইয়া একটি বিদেশী ভাষা শিখিতে হয়। যাহাদের ভাষা শিক্ষার প্রতিভা আছে, তাহাদিগকেও বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিতে যথেষ্ট পরিশ্রম ও শক্তি ব্যয় করিতে হয়। সুতরাং সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং ততোধিক নিকৃষ্ট ছেলে মেয়েদের পক্ষে বিদেশী ভাষা শিক্ষার চেষ্টা কি সম্পূর্ণ নিম্ফল হইবে না? বুদ্ধিমান ছাত্রের সময় ও অবসর জুটে, কিন্তু সাধারণ ছাত্রের সে অবসর কোথায়? যদিই বা কোন সাধারণ ছাত্র বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে অন্য সমস্ত বিষয় শিক্ষা করিবার পর্যাপ্ত সময় সে পায় না। সুতরাং তাহাকে ভাষা শিক্ষা এবং জ্ঞানলাভ এই দুইটির মধ্যে একটিকে বাছিয়া লইতে হয়। হয় তাহাকে ভাষায় দরিদ্র হইতে হইবে, অথবা তাহাকে সাধারণ শিক্ষা বিষয়ে নিকৃষ্ট হইতে হইবে।

 “ইংরাজী বলা, শোনা বা লেখা তাহাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় নহে, কেবলমাত্র ইংরাজী পড়িতে পারাই তাহাদের পক্ষে দরকার। কেন না ইংরাজী পড়িতে শিখিলে, ঐ ভাষায় সঞ্চিত বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারে তাহারা প্রবেশ করিতে পারে।”

 মিঃ এফ. জে. মোনাহান বাংলার দুইটি বিভাগে কমিশনারের কার্য করিয়াছেন। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং গভীর জ্ঞান আছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশনের সম্মুখে সাক্ষ্য দিতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন:

 “আমার মনে হয়, যে সব ইংরাজ স্কুল কলেজে ইংরাজী ভাষাকে শিক্ষার বাহন রাখিবার পক্ষপাতী তাঁহাদের মধ্যে অনেকে সাম্রাজ্যবাদের ভাবের দ্বারা প্রভাবাম্বিত। ইংরাজী ভাষাকে সাম্রাজ্যের মধ্যে ঐক্যসূত্ররূপে তাঁহারা গণ্য করেন;—এই ভাষাই ভারতের সর্বত্র সাধারণ ভাষা হইয়া উঠিবে, এমন স্বপ্নও তাঁহারা দেখেন।