পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৯৮
আত্মচরিত
১৯৮

 * * * “বহু, দৃষ্টান্ত হইতে বুঝা যায় যে, শিল্প বাণিজ্যে সাফল্য লাভ করিতে হইলে ইংরাজী ভাষার জ্ঞান অতি সামান্যই প্রয়োজন। এমন কি সেজন্য বেশী কিছু শিক্ষারই প্রয়োজন নাই। বড়বাজারের ক্রোরপতি মাড়োয়ারী বণিক ইংরাজী শেখা প্রয়োজন বোধ করেন নাই; কিন্তু তিনি ইংরাজীতে চিঠিপত্রাদি লিখিবার জন্য মাসিক ৪০ টাকা বেতনে একজন বি. এ. পাশ বাঙালীকে নিযুক্ত করেন। ইংরাজী ভাষার সহিত ভাল সাধারণ শিক্ষা ভারতবাসীর পক্ষে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুবিধার বটে; কিন্তু যদি বহুসংখ্যক ভারতবাসীকে শিল্প বাণিজ্যে দক্ষ করিয়া তুলিতে হয়, তাহা হইলে সম্ভবতঃ নিম্নলিখিত প্রণালীই উৎকৃষ্ট হইবে। ছেলেরা যত শীঘ্র সম্ভব স্কুলে কাজ চালানো গোছের কিছু ইংরাজী, সঙ্গে সঙ্গে অঙ্ক ও হিসাবপত্র রাখা শিখিবে, তারপর অল্প বয়সেই তাহাদিগকে কোন বাণিজ্য বা শিল্প ব্যবসায়ে শিক্ষানবীশ করিয়া দিতে হইবে।

 “আমার মনে হয়, ভারতবর্ষের মত দেশে, যেখানে বহু বিচিত্র জাতি, ভাষা, সভ্যতা, আদর্শ, ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্র বিদ্যমান, সেখানে বিদেশী ভাষার মধ্য দিয়া একই প্রণালীতে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা মহা ভ্রম। তার পর সর্ব শ্রেণীর সরকারী চাকরী এবং ওকালতী, ডাক্তারী প্রভৃতি ব্যবসায়ে প্রবেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিকেই একমাত্র উপায় রূপে নির্দিষ্ট করা আরো ভুল। মধ্যবিত্ত ও উচ্চশ্রেণীর ভারতবাসীদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়াছে, তাহার অনেকটা এই কারণ হইতেই উদ্ভূত বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমার প্রস্তাব এই যে, সরকারী চাকরীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাকে আর একমাত্র যোগ্যতা রূপে গণ্য করা হইবে না, অবশ্য, যে সব কাজের জন্য টেকনিক্যাল বা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন, সেগুলির কথা স্বতন্ত্র। পক্ষান্তরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকেও উদারতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। যে কলেজ বা উচ্চশ্রেণীর প্রতিষ্ঠান বিবিধ বিষয়ে শিক্ষা দিবে, সেগুলিকে ইহার অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে, বিভিন্ন শ্রেণীর ভাষাকে শিক্ষার বাহন রূপে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল দেখিবেন যে, শিক্ষার আদর্শ ঠিক আছে কিনা। অধিকাংশ ছাত্রের পক্ষে মাতৃভাষাই উপযুক্ত শিক্ষার বাহন হইবে; কাহারও কাহারও পক্ষে অবশ্য ইংরাজী ভাষাও শিক্ষার বাহন হইতে পারে।”

 ১৯২৬ সালে মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাধি বিতরণের সময় আমি যে বক্তৃতা দিয়াছিলাম তাহার কিয়দংশ এই প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করিতেছি।

 “ভারতে যে শিক্ষা প্রণালী বর্তমানে প্রচলিত, তাহা পরীক্ষা করিলে বলিতে হইবে, আমাদের সর্ব প্রথম অপরাধ বিদেশী ভাষাকে শিক্ষার বাহন করা। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাদের শিক্ষানীতির এই গুরুতর ভ্রম—যাহা আমাদের বুদ্ধি ও প্রতিভার বিকাশের পথ রুদ্ধ করিয়াছে—আমরা অতি অল্প দিন পূর্বেই আবিষ্কার করিয়াছি। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখনও পর্যন্ত, আমাদের কোন কোন সুপরিচিত শিক্ষা ব্যবসায়ী মনে করেন যে ইংরাজী ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার শ্রেণীতে গণ্য করিলে, তাহার ফল ঘোর অনিষ্টকর হইবে। যাহাতে কাহারও মনে কোন ভ্রান্ত ধারণা না হইতে পারে, সেজন্য পরিষ্কার করিয়া বলা প্রয়োজন যে ইংরাজী বা অপর কোন বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রতি আমি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছি না; কেননা, ঐ সব ভাষা শিক্ষার ফলে জ্ঞানের নূতন দ্বার খুলিয়া যায়। শিক্ষিত ব্যক্তিকে প্রথমতঃ সব বিষয়ের মোটামুটি জ্ঞান লাভ করিতে হইবে এবং মাতৃভাষার সাহায্যেই এই শিক্ষা যথাসম্ভব কম সময়ে উত্তমরূপে হইতে পারে। পাটীগণিত, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, তর্কশাস্ত্র এবং ভূগোল মাতৃভাষার সাহায্যেই সহজে শিক্ষা করা যাইতে পারে। উচ্চতর শিক্ষার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ইহাই সর্বোৎকৃষ্ট উপার।”