পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
২০১

 “জ্ঞানানুশীলনের উদ্দেশ্যই জ্ঞানলাভ। মানুষের মনের গঠন এমনই যে, জ্ঞানলাভই জ্ঞানের পুরস্কাররূপে গণ্য হইতে পারে।”

 বহু প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ও ব্যবসায়ীর উক্তি হইতে বুঝা যাইবে যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কারের প্রয়োজন কত গুরুতর। এডিসন বলিয়াছেন,— “সাধারণ কলেজ গ্রাজুয়েটদের জন্য এক পয়সাও দিতে আমি প্রস্তুত নহি।” “যে কেবল ইতিহাসের পাতার কয়েকটি তারিখ মুখেস্থ করিয়া রাখিয়াছে, সে শিক্ষিত ব্যক্তি নহে; যে নিজে কোন কাজ সসম্পন্ন করিতে পারে, সেই শিক্ষিত ব্যক্তি। যতই কলেজের উপাধি লাভ করুক না কেন, যে চিন্তা করিতে পারে না, তাহাকে শিক্ষিত ব্যক্তি বলা যায় না।” (হেনরী ফোর্ড)

 সম্প্রতি ল্যাক্সি প্রায় এইরূপ ভাষাতেই অনরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন:—“কারখানার প্রণালীতে শিক্ষাদানের একটা রীতি আছে। এই উপায়ে হাজারে হাজারে ‘শিক্ষিত ব্যক্তি’ তৈরী করা যাইতে পারে। কিন্তু চিন্তাশক্তিসম্পন্ন মন তৈরী করাই যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, তবে এ উপায় বিপজ্জনক।”

 এই “দলে দলে গ্রাজুয়েট সৃষ্টি” সম্বন্ধে মুসোলিনী বলিয়াছেন:—

 “শিক্ষার জন্য যোগ্য ছাত্র নির্বাচন এবং বৃত্তি শিক্ষার ভাল ব্যবস্থা আমাদের নাই। আমাদের শিক্ষার ঘানি হইতে একই ধরণের ছাত্র দলে দলে বাহির হইতেছে এবং তাহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারী চাকরী গ্রহণ করিয়া জীবন শেষ করিতেছে। এই সব ব্যক্তিদের দ্বারা সরকারী চাকরীর আদর্শ পর্যন্ত নীচু হইয়া পড়ে। আইন ও চিকিৎসা নামধেয় তথাকথিত ‘স্বাধীন ব্যবসায়ে’ বিশ্ববিদ্যালয় আর কতকগুলি পুতুল তৈরী করে।”

 “জাতীয় জীবনের উপর যাহার এমন অসাধারণ প্রভাব সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে নূতন করিয়া গড়িবার সময় আসিয়াছে।” (আত্মজীবনী)

 “গ্রন্থ-সংগ্রহই এ যুগের যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়”—কার্লাইল তাঁহার The Hero as Man of Letters নামক নিবন্ধে এই কথা বলিয়াছেন।

 মিঃ এইচ, জি, ওয়েল্স, এই কথাটিরই[] বিস্তৃত ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন:—

 “অধ্যাপকের বক্তৃতা নয়, উৎকৃষ্ট গ্রন্থসমূহকেই শিক্ষার ভিত্তি রূপে গ্রহণ করিলে, তাহার ফল বহুদূর প্রসারী হইয়া পড়ে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে শিক্ষালাভ করিবার পুরাতন প্রথার দাসত্ব লোপ পায়। নির্দিষ্ট কোন ঘরে যাইয়া নির্দিষ্ট কোন সময়ে অধ্যাপকের শ্রীমুখ হইতে অমৃতময় বাণী শুনিবার প্রয়োজন ছাত্রদের আর থাকে না। যে যুবক কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সুসজ্জিত কক্ষে বেলা ১১টার সময় পড়ে এবং যে যুবক সমস্ত দিন কাজ করিয়া রাত্রি ১১টার সময় গ্লাসগো সহরে কোন ক্ষুদ্র গৃহে বসিয়া পড়ে,— তাহাদের মধ্যে আর কোন প্রভেদ থাকে না।”


  1. কার্লাইল এতদূর পর্যন্ত বলিয়াছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় উঠাইয়া দিলেও চলে। তিনি বলিতেছেন:
     “বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বর্তমান যুগের সৃষ্টি—শ্রদ্ধার বস্তু। গ্রন্থ সংগ্রহ ইহার উপরে অশেষ প্রভাব বিস্তার করে। যে সময়ে কোন বই পাওয়া যাইত না, সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উদ্ভব হয়। তখনকার দিনে একখানি বইয়ের জন্য লোকে নিজের এক খণ্ড ভূ-সম্পত্তি পর্যন্ত দিতে বাধ্য হইত। সেই সময়ে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি যে ছাত্র সংগ্রহ করিয়া তাঁহাদিগকে শিক্ষাদান করিতে চেষ্টা করিবেন, ইহার প্রয়োজন ছিল। আবেলার্ডের নিকট জ্ঞানলাভ করিতে হইলে, তাঁহার নিকট যাইতে হইত। সহস্র সহস্র ছাত্র আবেলার্ড এবং তাঁহার দার্শনিক মতবাদ জানিবার জন্য তাঁহার নিকটে যাইত।”