যদি উপযুক্ত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চলে,—তবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ জাতির প্রভূত হিত সাধন করিতে পারে। ষ্টীট তাঁহার “প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিক” গ্রন্থে এই ভাবটি বেশ পরিষ্কাররূপে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।
“ম্যাসারিক তাঁহার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে এবং যে সব ছাত্র পরবর্তী কালে তাঁহার নিকট পড়িয়াছিল, তাহাদিগকে দেখিয়া, শিক্ষা সম্বন্ধে অভিমত গঠন করিয়াছিলেন। বোহিমিয়ার শিক্ষা প্রণালীর বিরুদ্ধে তাঁহার প্রধান বক্তব্য এই যে, ইহার দ্বারা চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য, আত্মজ্ঞান এবং আত্মমর্য্যাদা বোধ জন্মে না। ইহার দ্বারা পরীক্ষায় পাশ করিবার উদ্দেশ্যে পল্লবগ্রাহিতাই প্রশ্রয় পায়,—প্রকৃত জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাঁহার নিজের কথা একটু স্বতন্ত্র। গৃহের প্রভাব হইতে দূরে থাকিয়া স্বোপার্জিত অর্থে তাঁহাকে জীবিকা নির্বাহ করিতে হইয়াছিল, তাহার ফলে স্বভাবতঃই তিনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার ক্ষমতা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু অন্য যাঁহারা তাঁহার চেয়ে অধিকতর স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে লালিত হইয়াছিলেন, ছাত্রজীবন তাঁহাদের চরিত্রগঠনে সহায়তা করে নাই। অর্থোপার্জন, কোন নিরাপদ সরকারী চাকরী লাভ এবং পেন্সন পাওয়ার নিশ্চয়তা, ইহা ভিন্ন ঐ সব ছাত্রদের মধ্যে আর কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। ম্যাসারিক ইহার মধ্যে দেখিয়াছিলেন,—মৃত্যুভীতি ও সংগ্রামময় জীবনের সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা; সংক্ষেপে যে সব গুণ থাকিলে জননায়ক হওয়া যাইতে পারে, তাহার সম্পূর্ণ অভাব।
“ম্যাসারিকের মত এই যে, ছেলেরা স্কুলে যাহা শিখে, পরবর্তী কালে তাহা সমস্তই ভুলিয়া যায়। সুতরাং অন্ততঃপক্ষে, শিক্ষার প্রথম অবস্থায়, ছেলেদের কেবল কতকগুলি তথ্য গলাধঃকরণ করাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে, তাহাদের মনে এমন কৌতূহল জাগ্রত করা উচিত যাহাতে তাহারা নিজেরাই তথ্য নির্ধারণে সক্ষম হইতে পারে। এরূপ কৌতুহল জাগ্রত করিবার প্রধান উপায়, শিক্ষককে নিজে সেই বিষয়ে আগ্রহশীল হইতে হইবে। শিক্ষক রূপে ম্যাসারিকের সাফল্যের কারণ বোধ হয় এই যে, তিনি যে বিষয় শিখাইতেন, সে বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন। যুবক অবস্থায় তিনি বালকদের শিক্ষকতা করিতেন এবং পরবর্তীকালে প্রাগ সহরে তাঁহার ক্লাসে স্লাভ দেশের সর্বত্র হইতে তাঁহার নিকট পড়িবার জন্য ছাত্রেরা আসিত। সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষাদান কার্যে তিনি এইরূপ সাফল্যলাভ করিয়াছিলেন।
“একই ছাঁচে ঢালা, একই প্রকৃতির শত শত গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করা তাঁহার লক্ষ্য ছিল না। তিনি এমন এক শ্রেণীর লোক তৈরী করিতে চাহিয়াছিলেন, যাহাদের চিন্তার স্বাধীনতা জন্মিবে। তাঁহার মতে, শিক্ষার লক্ষ্য হইবে, মানুষের প্রকৃতিকে এমনভাবে গঠন করা যাহার ফলে কোন বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হইলে, সে নিজেই তাহার সমাধান করিতে পারে। বাল্য বয়স হইতে ছাত্রদের কেবল কতকগুলি তথ্য শিখাইলে চলিবে না, নির্ভুল ও সুশৃঙ্খল ভাবে কাজ করিবার এবং মনঃসংযোগ করিবার অভ্যাস তাহাদিগকে শিক্ষা দিতে হইবে।”
হার্বার্ট স্পেন্সার যথার্থই বলিয়াছেন,—“বিদ্যানুশীলনের জন্য পুস্তকের প্রয়োজনীয়তাকে খুব বেশী অতিরঞ্জিত করা হয়। প্রত্যক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা পরোক্ষ ভাবে লব্ধ জ্ঞানের মূল্য কম হওয়া উচিত এবং জ্ঞান প্রত্যক্ষভাবে লাভ করাই সঙ্গত, কিন্তু প্রচলিত ধারণা তাহার বিপরীত বলিলেই হয়। ছাপা বইয়ের পাতা হইতে সংগৃহীত বিদ্যা শিক্ষার অঙ্গ বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু যে বিদ্যা জীবন এবং প্রকৃতির নিকট হইতে সাক্ষাৎভাবে লব্ধ তাহা শিক্ষার অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হয় না। পুস্তক অধ্যয়নের অর্থ অন্যের দৃষ্টি দিয়া দেখা, নিজের ইন্দ্রিয় প্রভৃতির দ্বারা না শিখিয়া অন্যের ইন্দ্রিয় বুদ্ধি প্রভৃতি দ্বারা শেখা। কিন্তু প্রচলিত ধারণা এমনই সংস্কারাচ্ছন্ন যে প্রত্যক্ষভাবে লব্ধ জ্ঞান