পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৪
আত্মচরিত

 অন্যত্র আমি বলিয়াছি, যে, আমার ছাত্রজীবনে আমি কেবল পাঠ্যপুস্তক পড়িয়াই সন্তুষ্ট হইতাম না, সেগুলিকে কেবল পথপ্রদর্শকরূপে ব্যবহার করিতাম। পক্ষান্তরে আমি ইংরাজী, জার্মান, ফরাসী সাময়িক পত্রাদি খুঁজিয়া মৌলিক প্রবন্ধসমূহ পড়িতাম। পূর্বেই বলিয়াছি যে, আমি নিজের চেষ্টায় লাটিন এবং ফরাসী ভাষা শিখি। আমি সেই বয়সেই সেক্সপীয়রের কয়েকখানি নাটক এবং ইংরাজী সাহিত্যের কয়েকখানি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। এই কারণে, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উচ্চ স্থান অধিকার করিতে পারি নাই এবং সাধারণ ছাত্র রূপে গণ্য হইতাম।

 আমার ছাত্রজীবনের সঙ্গে প্রেসিডেণ্ট ম্যাসারিকের ছাত্রজীবনের সাদৃশ্য দেখিয়া আমি বিস্মিত ও আনন্দিত হইলাম। “গ্রেট্‌স” “ডবল ফার্স্ট” প্রভৃতি পরীক্ষার সম্মানকে আমি বরাবরই কৃত্রিম জিনিষ বলিয়া গণ্য করিয়াছি।

 “ভিয়েনা এবং ব্রুনো উভয় স্থানের কোথাও তিনি শিক্ষকদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হইতে পারেন নাই। তাঁহারা তাঁহাকে সাধারণ ছাত্র বলিয়া মনে করিতেন, মেধাবী ছাত্ররূপে গণ্য করিতেন না। ইহার কারণ এই যে, ম্যাসারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঁধা প্রণালী মানিতেন না এবং কোন একটি বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হইতে চেষ্টা করিতেন না। ব্রুনোতে তিনি যে সর্বগ্রাসী জ্ঞানতৃষ্ণার পরিচয় দিয়াছিলেন, ভিয়েনাতে আসিয়া তাহা অতিরিক্তরূপে বাড়িয়া গেল।

 “এই সময়ে তিনি ‘ক্লাসিক’ সাহিত্য পড়িতে ভাল বাসিতেন। গ্রীক ও লাটিন সাহিত্যের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলী তিনি মূল ভাষাতেই পড়িয়াছিলেন। স্কুলের নির্দিষ্ট পাঠ্যে তাঁহার আশা মিটিত না। যদি কোন বিষয় পড়িতে হয়, তবে তাহা ভাল করিয়াই পড়িতে হইবে, ইহাই ছিল তাঁহার মত।......১৯ বৎসর বয়সেই তিনি যেন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষায় তাঁহার বিশেষ কোন উপকার হইবে না। তাঁহার সমসাময়িক অন্যান্য বুদ্ধিমান যুবকদের ন্যায় তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার ভবিষ্যৎ স্বীয় শক্তির উপরেই নির্ভর করিতেছে। সে ভবিষ্যৎ কিরূপে হইবে, তখন পর্যন্ত তাহা অবশ্য তিনি জানিতেন না। কিন্তু তিনি জানিতেন—সেই ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সাধন করিতে হইলে, তাঁহাকে কঠোর পরিশ্রম করিতে হইবে। কেবল বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান লাভ করিলেই চলিবে না, তাহার বাহিরে যে বৃহত্তর জ্ঞানরাজ্য পড়িয়া আছে, তাহার মধ্যে প্রবেশ করিতে হইবে। যে সব শক্তি মানব-জগতকে পরিচালনা করিতেছে, ম্যাসারিকের পক্ষে তাহার মূল রহস্য অবগত হওয়া প্রয়োজন ছিল।”

 বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনের ফলে যে অনিষ্ট হইয়াছে, জনৈক চিন্তাশীল লেখক তাহা নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করিয়াছেন:—

 “পাঠ্য পুস্তক নির্দিষ্ট করা—বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিশাপ স্বরূপ। গোড়ার কথা এই যে, ছাত্রেরা কোন বিষয়ের মূল বস্তু প্রথমতঃ সাক্ষাৎ সম্বন্ধে শিখিবে। যদি সে সেক্সপীয়র পড়ে, সেক্সপীয়রের মূল গ্রন্থ তাহাকে পড়িতে হইবে। ব্রাড্‌লে অথবা কিট্‌রেজ সেক্সপীয়র পড়িয়া কি শিখিয়াছেন, তাহা জানাই ছাত্রদের পক্ষে যথেষ্ট নয়। যদি সে রাষ্ট্রনীতির ঐতিহাসিক ধারা জানিতে চায়, তবে তাহাকে প্লেটো ও আরিস্টট্‌ল, লক, হবস্ এবং রুশোর বই পড়িতে হইবে। এবং সেই সমস্ত জানিয়া যদি সে পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত অসংখ্য নামের তালিকা আবৃত্তি করিতে না পারে, তাহা হইলেও তাহার পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কারণ হইবে না। যদি সে অর্থনীতির শিক্ষার্থী হয়, তবে অ্যাডাম স্মিথ ও রিকার্ডোর গ্রন্থ পড়া তাহার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন। ঐ সমস্ত চিন্তা-প্রবর্তকদের