গ্রন্থ পড়িলে, তাহার মনের শক্তি বৃদ্ধি পাইবে, কোন অধ্যাপকের লেখা পাঠ্য গ্রন্থ পড়িয়া তার চেয়ে বেশী জ্ঞান সে লাভ করিতে পারিবে না।” (হ্যারল্ড ল্যাস্কি)
মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উপলক্ষে প্রদত্ত অভিভাষণে (১৯২৬) আমি বলিয়াছিলাম:—
“সকলেই স্বীকার করিবেন যে, মাধ্যমিক শিক্ষার (সেকেণ্ডারী এডুকেশান) ব্যবস্থা যদি উন্নততর করা হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় অনেক অনাবশ্যক অঙ্গ বর্জন করা যাইতে পারে এবং তাহার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যথার্থ উন্নতি হইতে পারে। শিক্ষার যে গতানুগতিক অংশের স্কুলেই শেষ হওয়া উচিত, তাহার জের এখন দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত টানা হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা উন্নততর করিলে, ইহার অবসান হইবে এবং ফলে বিশ্ববিদ্যালয় যথার্থরূপে বিদ্যা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হইয়া উঠিবে। এ বিষয়ে আরও একটু বিস্তৃতভাবে বলা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষাপ্রণালীতে এত বেশী খুঁটিনাটি শিক্ষা দেওয়া হয় যে, ইহার কাজ অনেকটা সেকেণ্ডারী স্কুলের মতই হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এমন কি পোষ্ট-গ্রাজুয়েট ক্লাসে পর্যন্ত কেহ কেহ রীতিমত “একসারসাইজ” দিবার জন্য জিদ করেন। আমি এমন কথা বলি না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার নামে, ছেলেদের ভিতর আলস্যের প্রশ্রয় দেওয়া হোক। মানসিক যোগ্যতার সঙ্গে পরিশ্রম করিবার অভ্যাস, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করিবার গোড়ার সর্ত্ত হওয়া উচিত। আমি ইহাই বলিতে চাই যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে অধ্যাপকদের বক্তৃতা ও ‘একসারসাইজ’ দেওয়ার যে বাঁধাধরা নিয়ম আছে, তাহা তুলিয়া দিতে হইবে; অন্যথা ছাত্রদের মানসিক শক্তির বিকাশ হইতে পারে না। অবশ্য, বক্তৃতা দেওয়ার রীতির দ্বারা মনে হইতে পারে, কিছু কাজ হইতেছে। কিন্তু যদি কোন ছাত্র নিজের সময়ের সদ্ব্যবহার করিতে চায়, তাহা হইলে সে দেখিবে যে, এই সব বক্তৃতায় ক্লাশ হইতে অনুপস্থিত থাকাই তাহার পক্ষে বেশী লাভজনক। এই বাঁধাধরা বক্তৃতা দেওয়ার রীতির প্রধান ত্রুটী এই যে, ছাত্রেরা কোন বিষয় না বুঝিতে পারিলেও, অধ্যাপককে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার সুযোগ কদাচিৎ পাইয়া থাকে। এই ত্রুটী সংশোধন করিবার জন্য কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টিউটোরিয়াল সিস্টেম’ বা ছাত্রদিগকে ‘গৃহশিক্ষা’ দেওয়ার রীতিও প্রবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু যদিও এই ব্যবস্থায় প্রথমোক্ত রীতির ত্রুটী কিছু সংশোধিত হয়, তথাপি মোটের উপর ইহা অনেকটা পরীক্ষায় পাশ করাইবার জন্য ‘ছেলে তৈরী’ করিবার মত। ইহাতে ছেলেদের বিশেষ কিছু মানসিক উন্নতি হয় না। ইহার বিপরীত শিক্ষাপ্রণালীর কথা বিবেচনা করিয়া দেখুন। অধ্যাপকেরা ছাত্রদের নিকট কেবল কতকগুলি গ্রন্থের নাম করেন এবং ঐ সমস্ত গ্রন্থে যে সব সমস্যা আলোচিত হইয়াছে, তাহার উল্লেখ করেন। ছাত্রেরা ঐ সব গ্রন্থ পড়ে, তাহাতে যে সমস্ত সমস্যার আলোচনা হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে চিন্তা করে, নিজেরাই সমাধানের উপায় আবিষ্কার করে এবং কলেজের তর্কসভার অধ্যাপক ও সহপাঠীদের সঙ্গে ঐ বিষয়ে তর্কবিতর্ক ও আলোচনা করে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এই প্রণালীতে ছাত্রের বিশ্লেষণ ও সমীকরণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং যদিও প্রথম প্রথম তাহার পক্ষে এই প্রণালী কষ্টকর মনে হইতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ইহারই মধ্য দিয়া নিজের একটা ‘জ্ঞানরাজ্য’ গড়িয়া তোলে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নততর না হইলে, এই প্রণালী প্রবর্তিত হইতে পারে না।
“প্রশ্ন হইতে পারে, যদি অধ্যাপকদের বক্তৃতা দেওয়ার রীতি বন্ধ করা যায়, তাহা হইলে তাঁহাদের কাজ কি হইবে? উত্তর অতি স্পষ্ট—অধ্যাপকদের প্রধান কাজ হইরে মৌলিক গবেষণা। অধ্যাপক যেখানে মনে করেন যে, তাঁহার নূতন কিছু শিক্ষা দিবার আছে,