পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০৮
আত্মচরিত

স্বীকৃত হইতেছে;—তৎসত্ত্বেও এই ভ্রান্ত ধারণা কিছুতেই দূর হইতেছে না যে, যাহারা ভারতে শিক্ষা লাভ করে, তাহাদের চেয়ে যাহারা বিদেশে শিক্ষা লাভ করে তাহারা সরকারী কাজে বেশী সুযোগ ও সুবিধা পায়। এই শ্রেণীর ছাত্রেরাই বেশীর ভাগ বিদেশে গিয়া সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভাগে উপাধি লাভের জন্য অধ্যয়ন করে। ঐরূপ শিক্ষা লাভ করিলেই কোন বিশেষ সরকারী কাজে তাহাদের যোগ্যতা জন্মে না। ঐ ধরণের শিক্ষা ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও তাহারা পাইতে পারিত। এই শ্রেণীর ছাত্রদের মধ্যে অনেকে ব্যারিস্টার হইবার জন্য আইন পড়ে, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্রও ইহাদের মধ্যে কম নয়। ১৯২৮ সালে ২৬৬ জন ছাত্র সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়াছিল। তাহাদের মধ্যে ১৭০ জনই ছিল ভারতীয় এবং এই ১৭০ জনের মধ্যে মাত্র ১৭ জন পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করিয়াছিল।

 “ইহাদের মধ্যে আবার এমন সব ছাত্রও দেখা যায় যাহাদের বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতে পড়িবার মত যোগ্যতা নাই। প্রতি বৎসরই কতকগুলি ছাত্র অতি সামান্য সম্বল লইয়া এদেশে আসে; তাহাদের তীক্ষ বুদ্ধি, অধ্যবসায়, ও সাহস প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু অর্থ ও যোগ্যতার অভাবে তাহারা সাফল্য লাভ করিতে পারে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর ভারতীয় ছাত্র নিঃসম্বল অবস্থায় ভবঘুরের মত এদেশে আসে, শীঘ্রই তাহারা পিতামাতা ও অভিভাবকদের উদ্বেগের কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষও তাহাদের জন্য চিন্তিত হইয়া উঠেন। যখন দেশ হইতে তাহাদের টাকা আসা বন্ধ হয় অথবা অন্য কারণে তাহারা নিঃসম্বল হইয়া পড়ে, তখন হাই কমিশনারের আফিস হইতে অর্থ সাহায্য করিয়া তাহাদিগকে ভারতে পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিতে হয়।

 “এ সমস্ত কথা পূর্বেও বহুবার বলা হইয়াছে, কিন্তু ভারতীয় জনমতকে সচেতন করিতে পুনরাবৃত্তি করিবার প্রয়োজন আছে। ইহা কিছুমাত্র অত্যুক্তি নহে যে প্রতি বৎসর যে সব ছাত্র ভারত হইতে বিদেশে আসে, তাহাদের অধিকাংশের দ্বারাই আর্থিক হিসাবে বা বিদ্যার দিক দিয়া ভারতের কোন উপকার হয় না। ইহারা হতাশ ও বিরক্ত হইয়া দেশে ফিরিয়া যায়, কোন কাজের উপযুক্ত বিশেষ কোন যোগ্যতা লাভ করে না, এবং অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক জীবনের স্নেহবন্ধন হইতে তাহারা বিচ্যুত হইয়া পড়ে, স্বজাতির স্বার্থের সঙ্গেও তাহাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়। একথা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, এই ভাবে প্রতি বৎসর ভারতের যুবকশক্তির বহু অপব্যয় হইতেছে। ভারতের যুবকদের মঙ্গল কামনা যাঁহারা করেন, তাঁহাদের এই গুরুতর বিষয়টি বিশেষ ভাবে চিন্তা করিয়া কর্তব্য নির্ণয় করা প্রয়োজন।”

 একটা কথা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীরা নিজেদের খুবই উচ্চ শ্রেণীর জীব বলিয়া মনে করে বটে, কিন্তু এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে তাহাদের তুলনা করিলে, অনেক স্থলেই তাহাদের সে ধারণা ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হয়।

 দৃষ্টান্ত স্বরূপ, দর্শনশাস্ত্রের কথা ধরা যাক। ডাঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের নাম অবশ্যই এক্ষেত্রে সর্বাগ্রগণ্য। তাঁহার বিরাট জ্ঞানভাণ্ডার ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র-শিক্ষার্থীদের চিত্তে ঈর্ষা ও নৈরাশ্যের সঞ্চার করে। তাঁহার সমকক্ষতা লাভের কল্পনাও তাঁহারা করিতে পারেন না। এ কথা সত্য যে, তিনি এমন কোন গ্রন্থ প্রকাশ করেন নাই, যাহার দ্বারা তাঁহার নাম প্রসিদ্ধ হইতে পারে। কিন্তু কয়েক পুরুষ ধরিয়া যে সব ছাত্র তাঁহার পদমূলে বসিয়া শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা ডাঃ শীলের নিকট তাঁহাদের অশেষ ঋণ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার