পদার্থ-বিজ্ঞান বিভাগে দেখা যায়, ‘রামন তত্ত্বে’র (Raman Effect) আবিষ্কর্তা অধ্যাপক রামন[১] স্বীয় চেষ্টাতেই বিজ্ঞান বিদ্যার নিগূঢ় রহস্য অধিগত করিয়াছেন। তাঁহার সমস্ত প্রসিদ্ধ মৌলিক গবেষণা কলিকাতার লেবরেটরীতেই করা হইয়াছে।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ভাণ্ডারে ধর, ঘোষ, মুখোপাধ্যায়, সাহা, বসু প্রভৃতির অবদানের কথা পূর্বেই বর্ণনা করিয়াছি (১৩শ ও ১৪শ অধ্যায়)। এস্থলে শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে, তাঁহাদের প্রত্যেকে কলিকাতার লেবরেটরীতে গবেষণা করিয়াই খ্যাতি লাভ করেন। আমি কয়েক বার জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলিয়াছি যে, ঘোষ ও সাহা লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া শিক্ষা সমাপন করিলেও ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি, এস-সি, উপাধি ইচ্ছা করিয়াই গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাঁহাদের মনে হইয়াছিল যে তদ্দারা তাঁহাদের স্বীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টর’ উপাধির গৌরব ক্ষুণ্ণ হইবে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু (বোস-আইনষ্টাইন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত) যদিও বিদেশে গিয়া তথাকার প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ পদার্থতত্ত্ব-বিদগণের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন; তথাপি ঐ একই মনোভাবের বশবর্তী হইয়া কোন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় হইতে উপাধি গ্রহণ করেন নাই।
এই প্রসঙ্গে আমার আর একজন প্রিয় ছাত্রের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন,—আমি অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায়ের কথা বলিতেছি।
একটি আশার লক্ষণ এই যে, আমি যে সব কথা বলিলাম, তাহা এদেশে অধ্যয়নকারী ছাত্রেরা নিজেরাই ক্রমে উপলব্ধি করিতে পারিতেছেন। লণ্ডনে ভারতীয় ছাত্র সম্মেলনে (ডিসেম্বর, ১৯৩১) ‘ব্রিটিশ ডিগ্রীর মূল্য’ আলোচনা প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর শ্রীযুত অনাথনাথ বসু বলেন, “ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মূল্য ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুল্য নহে, একথা বলিলে, আমাদের মনের শোচনীয় অবস্থার পরিচয়ই দেওয়া হয়। আমি বিশ্বাস করি না যে, কোন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বৎসর পড়িয়া যে শিক্ষা লাভ করা যায়, কোন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বৎসর পড়িয়া সেইরূপ শিক্ষা লাভ করা যায় না। অথচ ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারীরা উচ্চ পদ ও মোটা বেতন পান। ইহা মর্যাদাবোধের কথা এবং ইহার মূলে রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা আমাদিগকে বৃদ্ধি করিতে হইবে।”
শ্রীযুত এম, ভি, গঙ্গাধরন বিলাতে ভারতীয় ছাত্রের আইন শিক্ষার নিন্দা করিয়াছেন। তিনি বলেন, একজন ভারতে শিক্ষিত আইনজ্ঞ কেন যে বিলাতে শিক্ষিত কোন আইনজ্ঞ অপেক্ষা কম দক্ষ হইবেন, তাহার কারণ তিনি বুঝিতে পারেন না। “আমি সেই দিনের প্রতীক্ষা করিতেছি, যেদিন ভারতীয় ছাত্রেরা বিলাতের ‘ইন্স্ অব কোর্টে’র কমন রুমে ‘আশ্চর্য বস্তু’ বলিয়া গণ্য হইবে। কিছুদিন পূর্বে পর্যন্ত বিলাতে শিক্ষিত আইনজ্ঞেরা, কিছু বেশী সুবিধা ভোগ করিতেন। কিন্তু ঐ সমস্ত সুবিধা তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সুতরাং এখন ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে বিলাতে গিয়া আইন শিখিবার কোনই প্রয়োজন নাই।”
দেশী অথবা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভ করিবার দুর্নিবার মোহ সম্বন্ধে আমার স্বদেশবাসীর বিশেষভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। বাংলাদেশ তাহার
- ↑ অধ্যাপক রামনের ‘নোবেল প্রাইজ’ পাওয়ার বহু পূর্বে এই প্রসঙ্গ লিখিত হইয়াছে। অল্প দিন পূর্বে (২৭—৬—৩১); কলিকাতা কর্পোরেশান অধ্যাপক রামনকে সম্বর্ধনা করিবার সময় এই বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন:—
“ভারতে প্রাপ্ত শিক্ষা বলে, ভারতীয় লেবরেটরীতে গবেষণা করিয়া আপনি অপূর্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। এই দেশ বৈজ্ঞানিক গবেষণার কিরূপ কৃতিত্ব লাভ করিয়াছে, আপনার কার্য: আপনি তাহা প্রদর্শন করিয়াছেন।”