পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিংশ পরিচ্ছেদ
২১৩

নিকট তদুদ্দেশ্যে অনুরোধ করিলেন। ইহার ফলে লে-ব্ল্যাঙ্ক লবণ হইতে সোডা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিকগণ বীটমূল হইতে চিনি তৈরীর প্রণালী আবিষ্কার করিলেন। এই সমস্ত দৃষ্টান্ত সেই প্রাচীন প্রবাদবাক্যেরই সমর্থন করে—প্রয়োজন হইতেই নব নব উদ্ভাবনের জন্ম।

 ব্রিটিশ রাসায়নিক ও বৈজ্ঞানিকরাও পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহেন। তাঁহারা বেশ জানিতেন যে, তাঁহাদের প্রতিদ্বন্দী জার্মানী রাসায়নিক শিল্পে বহুদূর অগ্রসর হইয়াছে এবং তাহার সমকক্ষতা লাভ করিতে হইলে প্রবল প্রচেষ্টা করিতে হইবে। ইংলণ্ডের স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হইয়া উঠিল। যে দেশ নিউটন, ফ্যারাডে এবং র‍্যামজের জন্ম দিয়াছে, সে দেশ রাসায়নিক সংগ্রামে পশ্চাৎপদ হইয়া থাকিতে পারে না। এই সন্ধিক্ষণে ইংলণ্ড কি করিল, তাহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ইংলণ্ড এই সংগ্রামে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়াছেন। লণ্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেণ্ট এই সময়ে আমার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করিয়া একখানি পত্র লিখেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের রাসায়নিক বিভাগে আমাদের সাধারণ কাজের অথবা ছাত্রদের গবেষণা সংক্রান্ত কাজের মোটের উপর কোন ক্ষতি হয় নাই। চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ী প্রায় পঁচিশ বৎসরকাল প্রেসিডেন্সি কলেজে ডেমনস্ট্রেটর ছিলেন। তিনি বেশ হিসাব করিয়া রাসায়নিক দ্রব্য ও যন্ত্রপাতির বার্ষিক সরবরাহের ব্যবস্থা করিতেন। আমাদের লেবরেটারীতে ঐ সমস্ত জিনিস যথেষ্ট পরিমাণে মজুত ছিল। কতকগুলি রাসায়নিক দ্রব্য আমরা নিজেরাই প্রস্তুত করিলাম, ঐগুলি পূর্বে জার্মানী হইতে আমদানী করা হইত। কিন্তু আমাদের ফার্ম ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস’ হইতেই এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হইয়াছিল। এখান হইতে গবর্ণমেণ্টকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রিক অ্যাসিড সরবারহ করা হইল। সামরিক বিভাগে আমাদের জনৈক রাসায়নিকের প্রস্তুত ‘অগ্নি নির্বাপক’ এর খুব চাহিদা হইল। মেসোপটেমিয়ায় বারুদ ও বিস্ফোরকের গুদামের জন্য এগুলি চালান দেওয়া হইয়াছিল,— আমাদের রাসায়নিকগণের উদ্ভাবিত প্রণালীতে থাইওসাল্‌ফেটও প্রচুর পরিমাণে প্রস্তুত হইয়াছিল। চায়ের গুঁড়া হইতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফিনও তৈরী করা হইত। আমাদের কারখানায় অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে রাসায়নিক তুলাদণ্ডও তৈরী হইত। মোটের উপর, যুদ্ধের ফলে কারখানার কয়েকটি বিভাগের কাজ আশাতীতরূপে বাড়িয়া গিয়াছিল।

 ভারত ইউরোপীয় যুদ্ধে কম সাহায্য করে নাই। ভারতীয় সৈনিকরাই ইপ্রেসের যুদ্ধের সন্ধিক্ষণে মিত্রশক্তিকে রক্ষা করিয়াছিল। ভারতই মেসোপটেমিয়াতে শ্রমিক সরবরাহ করিয়াছিল। ভারত হইতেই রেলওয়ে লাইন, মালমশলা প্রভৃতি জাহাজে করিয়া লইয়া বাসরাতে বসানো হইয়াছিল। ছোট-বড় সমস্ত দেশীয় রাজারাই সৈন্য ও অর্থ দিয়া ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টকে সাহায্য করিয়াছিলেন। টাটা আয়রন ওয়ার্কসও যথেষ্ট কাজ করিয়াছিলেন; ইউরোপ ও আমেরিকা হইতে ইস্পাতের আমদানী বন্ধ হইয়া গিয়াছিল এবং টাটার কারখানার প্রস্তুত সমস্ত জিনিস গবর্ণমেণ্টের আয়ত্তাধীন হইয়াছিল।

 এই সন্ধিক্ষণে, ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ যেরূপ কাজ করিয়াছিল, তাহার জন্য শাসকেরা খুব প্রশংসা করিয়াছিলেন। ১৯১৬—১৮ সালের শিল্প কমিশন ভারত যাহাতে শিল্প সম্বন্ধে আত্মনির্ভরশীল হইতে পারে, তাহার সপক্ষে বহু যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন। “যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ফলে গবর্ণমেণ্ট এবং প্রধান শিল্প ব্যবসায়ীদের মত পরিবর্তন হইয়াছে। তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন, ভারতকে শিল্পজাত বিষয়ে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মরক্ষায় সক্ষম করিবার জন্য কলকারখানা স্থাপন করা প্রয়োজন। যুদ্ধের সময়ে বিদেশ হইতে শিল্পজাত আমদানীর প্রতীক্ষায় নিশ্চেষ্টভাবে বসিয়া থাকা এ যুগে আর সম্ভবপর নহে।”

 এখানে বলা প্রয়োজন যে, কেমিক্যাল সার্ভিস কমিটিতে আমি যে স্বতন্ত্র মন্তব্য