পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৪
আত্মচরিত

লিপিবদ্ধ করিয়াছিলাম, তাহাতে আমি দেখাইয়াছিলাম যে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমাদের দেশের লোকের কিরূপে ভ্রান্ত ধারণা আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালর ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সমূহে যে শিক্ষা দিয়া থাকে, তাহা অতিমাত্রায় সাহিত্যগন্ধী, অতএব কতকগুলি লোকের মতে উহার পরিবর্তে শিল্প-শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করিলেই, চারিদিকে যাদুমন্ত্র বলে শিল্পবাণিজ্য কলকারখানা গড়িয়া উঠিবে।

 স্যার এম, বিশ্বেশ্বরায়া যে একটি শিল্প মহাবিদ্যালয় বা টেকনলজিক্যাল ইউনিভারসিটি স্থাপন করিবার জন্য ব্যগ্র, তাহারও কারণ এই ভ্রান্ত ধারণা; তিনি বলিয়াছেন:—

 “শিক্ষা-ব্যবস্থা এমন করিতে হইবে, যাহার ফলে দেশের কর্মক্ষেত্রে সমস্ত বিভাগে কতকগুলি নেতা তৈরী হইয়া উঠিবে,—শাসক, শিল্প-বিশেষজ্ঞ, ইত্যাদি। যে সমস্ত যুবকদের যেদিকে রুচি ও যোগ্যতা আছে, তাহাদিগকে সেই সেই বিষয়ে এইভাবে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। যাহাদের নেতৃত্ব করিবার যোগ্যতা আছে এবং যাহারা শ্রমিক জনসাধারণ সেই দুই শ্রেণীই দেশের আর্থিক ব্যাপারের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই দুই শ্রেণীর সহযোগে ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া ওঠে। মধ্যবর্তী শ্রেণী যথা ফোরম্যান, কারিগর প্রভৃতি ইহারা স্বভাবতঃই তৈরী হইয়া উঠিবে,—ইহাদেরও প্রয়োজন আছে এবং তাহাদের উপযোগী শিক্ষার ব্যবস্থাও করিতে হইবে।” (অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত পঞ্চম বার্ষিক কনভোকেশান অভিভাষণ)

 ইহা অপেক্ষা ভ্রান্ত ধারণা আর কিছুই হইতে পারে না। প্রত্যেক দেশেই শিল্পবাণিজ্যের উন্নতি হইয়াছে, তাহার পরে বিজ্ঞান ও বিবিধ শিল্পবিদ্যা প্রভৃতি আসিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মৃৎপাত্র এবং মৃৎশিল্পের কথা ধরা যাক। এগুলির চল্‌তি নাম চীনামাটির বাসন এবং এই নাম হইতেই অনুমান করা যাইতে পারে,—যে অতি প্রাচীন কাল হইতে চীনদেশে এই শিল্প প্রচলিত ছিল। চীনারা ঐ শিল্পে বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছে এবং জাপান তাহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াছে।

 “মৃৎশিল্প রোমকদের অজ্ঞাত ছিল, কিন্তু চীনারা অতি প্রাচীনকাল হইতেই এ বিষয়ে দক্ষতা লাভ করে। (সান-ইয়াট-সেন তাঁহার Memories of a Chinese Revolutionary গ্রন্থে ইহার বিবরণ দিতে গিয়া বলিয়াছেন—“যে চীনা শিল্পীরা এই সব মৎশিল্প তৈরী করিত, তাহারা পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র জানিত না”)। প্রাচীন মিশরের কবরগুলির মধ্যে যে সব পাত্রের অবশেষ আছে, তাহাও মৃৎশিল্পজাতীয়। ইউরোপে মধ্যযুগে মৃৎপাত্রে রং করা খুবেই প্রচলিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে আলকেমিষ্ট পিটার বোনাস এবং আলবার্টাস ম্যাগনাস্, ঐ সময়ে যে প্রণালীতে মৃৎপাত্রে রং করা হইত, তাহার বর্ণনা করিয়াছেন। পরবর্তী শতাব্দীতে এই শিল্পের খুব উন্নতি হয়। অ্যাগ্রিকোলা এই শিল্প সম্বন্ধে বহু তথ্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

 “যাঁহারা মৃৎ শিল্পের উন্নতি সাধন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে বার্নার্ড প্যালিসির নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। রঙীন ও উজ্জ্বল মৃৎ শিল্প নির্মাণের জন্য তিনি বহু ত্যাগ স্বীকার করেন এবং এইরূপে আধুনিক মৃৎ শিল্পের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তাঁহার প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহ দ্বারা ইয়োরোপে তাঁহার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা প্রণালী সম্বন্ধে বহু তথ্য প্রচারিত হয়। কিন্তু L’Art de Terre et des Terres d’Argilé নামক তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্থে কেবল মৃৎশিল্পের কথাই আছে। ১৭০৯ খৃষ্টাব্দে বাটিকের মৃৎশিল্প সম্বন্ধে নূতন প্রণালী আবিষ্কার করেন এবং তাহার পর বৎসরে স্যাক্‌সনির মিসেন সহরে প্রসিদ্ধ মৃৎশিল্পের কারখানা স্থাপিত হয়।

 “মিসেনের কারখানার মৃৎশিল্পের নির্মাণ প্রণালী গোপন রাখা হইয়াছিল। সেইজন্য