পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১৬
আত্মচরিত

 আরও একটা কথা, যুবকটি হয়ত বিদেশের কোন টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করিয়াছে। বিদ্যালয়ে অধীত বিদ্যার সঙ্গে হাতেকলমে ঐরূপ কিছু ব্যবহারিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে শিল্পজাত তৈরী করিতে হইলে ঐ শিক্ষা বিশেষ কাজে আসে না। কোন কারখানায় প্রবেশ করিয়া, তাহার শিল্প প্রস্তুত প্রণালী অবগত হওয়া বড়ই কঠিন কাজ। ব্যবসায়ী ফার্ম প্রভৃতি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের মত উদার নহে। যে সমস্ত গূঢ় রহস্য তাহারা বহুবৎসরের সাধনা ও পরিশ্রমের ফলে অবগত হইয়াছে, সেগুলি বাহিরের লোককে শিখাইবার জন্য তাহারা ব্যগ্র নহে।

 এমার্সন বলেন, ব্যবসায়ীদের পরস্পরের মধ্যে বেশ ঈর্ষার ভাব আছে। একজন রাসায়নিক একজন সূত্রধরের নিকট তাহার ব্যবসায়ের গূঢ় কথা বলিতে পারে, কিন্তু তাহার সমব্যবসায়ী আর একজন রাসায়নিককে কিছুতেই তাহা বলিবে না।

 বিদেশে শিক্ষালাভার্থ যে সব যুবককে পাঠানো হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে অনেকেই সাফল্য লাভ করিতে পারে নাই। এমন কি কোন কোন প্রথম শ্রেণীর এম, এস-সি ডিগ্রীধারীরও এই দশা হইয়াছে। চীন দেশেও এইরূপ ভ্রান্ত ধারণার পরিণাম শোচনীয় হইয়াছে। একজন চিন্তাশীল লেখক কর্তৃক লিখিত চীন সম্বন্ধীয় গ্রন্থ হইতে কিয়দংশ নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি। এ বিষয়ে আমাদের দেশের সঙ্গে চীনের অবস্থার আশ্চর্য সাদৃশ্য দৃষ্ট হইবে।

 “প্রণালী উপনিবেশ (স্টেট্স, সেট্সমেণ্ট) এবং তাহার নিকটবর্তী অঞ্চলে চীনারা ব্যবসায়ে নহে, পণ্য উৎপাদনেও প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। টিন শিল্পের কথাই ধরা যাক। এই সব স্থানে নির্দিষ্ট আইন কানুন আছে, করের হারও অত্যধিক নয়; এবং মামলা মোকদমা নিষ্পত্তিরও সুব্যবস্থা আছে। এরূপ ক্ষেত্রে চীনারা ব্যবসায়ে এবং পণ্য উৎপাদনে অন্য সমস্ত জাতিকে পরাস্ত করিয়াছে।

 “তৎসত্ত্বেও একথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, বিদেশে এই সমস্ত স্থানে যে সমস্ত চীনা সাফল্য লাভ করিয়াছে, তাহারা খুব দরিদ্র অবস্থায় গিয়াছিল! এমন কি প্রথমতঃ কুলীর কাজ করিতেও গিয়াছিল। তারপর নিজেদের যোগ্যতা বলে তাহারা উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়াছে। এই সব স্থানে তাহাদের অসংখ্য জাতিকুটুম্বের কবল হইতে তাহারা অনেকটা মুক্ত; সুতরাং সহজে টাকা খাটাইতে পারে। শীঘ্রই কিছু অর্থ সঞ্চয় করিয়া ছোটখাট ঠিকা কাজ নেয়। তাহারা তাহাদের অধীনস্থ লোকদের ঘনিষ্ঠ সংশ্রবে থাকিয়া বুঝিতে পারে, কাহারা যোগ্য ফোরম্যান, কাহাদের উপর বেশী দায়িত্ব দেওয়া যায়, কাহারা কাজ করিতে ভয় পায়, কাহাদের সাহস বেশী ইত্যাদি। এইভাবে গোড়া হইতে কাজ করিতে করিতে তাহারা তাহাদের ব্যবসা গড়িয়া তোলে। হয়ত তাহারা ইংরাজী বা ডাচ ভাষাও কিছু কিছু শিখিয়া ফেলে এবং তাহার দ্বারা ব্যবসায়ের সুবিধা হয়। এইভাবে সুদীর্ঘ কালের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তাহারা ব্যবসায় চালাইবার উপযোগী এমন কতকগুলি বিধিব্যবস্থা গড়িয়া তোলে, যাহার ফলে কোন নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট বা ম্যানেজার সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করিতে পারে।” (বেকারঃ ১৭৯-৮০ পৃঃ)

 “চীনা মূলধনীরা সাংহাই, ক্যাণ্টন প্রভৃতি স্থানে যে সমস্ত কারখানা স্থাপন করিয়াছে, সেগুলির সঙ্গে পূর্বোক্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলির বিস্তর প্রভেদ। এই সমস্ত মূলধনীরা তাহাদের ছেলেদের বিদেশে শিক্ষার্থ প্রেরণ করে। ছেলেরা সেখানে ব্যবসা পরিচালনা প্রণালী ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষা করে। তাহারা স্পষ্ট দেখিতে পায়, চীন হইতে যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচা মাল বিদেশে রপ্তানী করা এবং বিদেশ হইতে শিল্পজাতরূপে ঐগুলি আমদানী করার মত অস্বাবাভাবিক ব্যাপার আর কিছু হইতে পারে না। তাহারা বুঝিতে