পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিংশ পরিচ্ছেদ
২১৭

পারে যে, বিদেশী শুল্ক এবং বিদেশী শ্রমিকদের অতিরিক্ত মজুরী বাদ দিয়া যদি মাল রপ্তানীর খরচা বাঁচানো যায়, তবে যথেষ্ট লাভ হইতে পারে। পিতাকে এই সব কথা তাহারা সহজেই বুঝাইয়া দেয়। তাহারা এ কথাও বলে যে, তাহারা ব্যবসায় জানে। তাহারা কি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় গ্রাজুয়েট হয় নাই? দুই বৎসর ফ্যাক্টরীতে কাজ করে নাই? পিতা সন্তুষ্ট হইয়া কারখানা স্থাপন করিবার জন্য মূলধন দেন। কারখানা তৈরীর কাজ আরম্ভ হয়। ঠিকাদারদের লইয়া গোলমাল হয়, কাজে বিলম্ব হয়, ভাল কাজ হয় না এবং সেরূপ অবস্থায় কাজ অগ্রাহ্য করিলে ঠিকাদারেরা ধর্মঘট করিয়া কাজ বন্ধ করে। কারখানা তৈরী করিতে বরাদ্দের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশী পড়ে, এরূপ প্রায়ই ঘটিয়া থাকে। পিতা বিরক্ত হইয়া উঠেন। তবু তিনি কারখানা তৈরী শেষ করিতে আরও টাকা দেন। কারখানা তৈরী হইলে, আসল কাজ আরম্ভ হয়। তখন কলকব্জার গোলযোগ ঘটিতে থাকে, নূতন কলকব্জায় প্রথম প্রথম এমন একটু আধটু গোলযোগ হয়ই। লোকে নানা কথা বলিতে থাকে। কাজ চালাইবার জন্য যথেষ্ট মূলধন পাওয়া যায় না। চীনা কারখানাগুলিতে মূলধন সম্বন্ধে বরাদ্দ প্রায়ই খুব কম করিয়া ধরা হয়। আমেরিকা অপেক্ষা চীনে মূলধন উঠিয়া আসিতে দেরী লাগে, আদায় হইতে বিলম্ব হয়। বকেয়া বাকী আদায় হওয়াও বেশী কঠিন। ইহার উপরে, ফোরম্যানদের মধ্যে বিবাদের ফলে যদি ধর্মঘট হয়, তবে এই সব অনভিজ্ঞ তরুণ কর্মাধ্যক্ষেরা নিশ্চয়ই কাজ ছাড়িয়া দিবে। তাহাদের ‘মুখ দেখানো ভার’ হইয়া পড়ে, তাহাদের পরিবারেরও সেই অবস্থা। তাহাদের অন্য নানা সুযোগ আছে। তাহারা সরকারী কাজের জন্য চেষ্টা করিতে থাকে। আর একটা পরিত্যক্ত শূন্য কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি হয়।

 “কিন্তু যদি এই সব যুবক নিঃসম্বল অবস্থায় কাজ আরম্ভ করিয়া কারখানা স্থাপন করিত, নিজের উপার্জিত এবং অতিকষ্টে সঞ্চিত অর্থ ব্যবসায়ে খাটাইত, মালমশলা, ঠিকাদার, মজুর প্রভৃতির সম্বন্ধে যদি তাহাদের বহু বৎসরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকিত, তাহা হইলে তাহাদের কাজে অসুবিধা ও গোলযোগ কম ঘটিত, ব্যবসায়ের উপরও তাহাদের এমন প্রাণের মায়া জন্মিত যে, উহাকে রক্ষা করিবার জন্য সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকার, সর্বপ্রকার উপায় অবলম্বন করিতে ত্রুটী করিত না। প্রথম আঘাতেই বিচলিত হইয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত কাজ ছাড়িয়া পলাইত না। প্রায় প্রত্যেক বড় বড় ব্যবসায়েই একটা দুর্যোগের সময় আসে; তাহা অতিক্রম করিতে পারিলে, সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ইহার জন্য যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা আবশ্যক, তাহা বর্তমান যুগের শিক্ষিত চীনা যুবকদের মধ্যে নাই। আমি পুনর্বার বলিতে চাই, শিক্ষিত ও পণ্ডিত চীন শিল্প গড়িয়া তুলিতে পারে নাই।” (বেকারঃ ১৮০—৮২ পৃঃ)

 শিক্ষিত কৃতবিদ্য ব্যক্তিরা ব্যবসা আরম্ভ করিয়া কিরূপে অকৃতকার্য হয়, তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত আমরা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছি। জার্মানী ও আমেরিকাতে শিক্ষিত বিজ্ঞানে কৃতবিদ্য (পি-এইচ, ডি) কয়েকজন ভারতীয় ছাত্রকে আমি জানি। তাহারা ঐ সব দেশে রাসায়নিক এবং বৈদ্যুতিক কারখানায় শিক্ষানবীশ হইয়া প্রবেশ করিবার সুযোগ পাইয়াছিল। দেশে ফিরিয়া তাহারা ঐ সব বিদেশী ফার্মের ‘ভ্রাম্যমান’ ক্যান্‌ভাসার হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

(২) “ট্রাস্ট” ও “ডাম্পিং”

 ইয়োরোপ ও আমেরিকাতে শিল্পপতিরা প্রচুর পরিমাণে পণ্য উৎপাদন করে। এক একটা কারখানায় দৈনিক যে পরিমাণে পণ্য উৎপন্ন হয়, তাহা শুনিলে স্তম্ভিত হইতে হয়।