পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২০
আত্মচরিত

 কোন শিল্প-প্রবর্তকের সম্মুখে কি বিরাট বাধা-বিপত্তি উপস্থিত হয়, ভারতে লোহা ও ষ্টীলের কারখানার প্রতিষ্ঠাতা পরলোকগত জে, এন, টাটার জীবনে তাহার দৃষ্টান্ত দেখা যায়; তিনি এই বিরাট প্রচেষ্টার সাফল্য দেখিয়া যাইতে পারেন নাই বটে, কিন্তু তিনিই ইহার পরিকল্পনার কারণ, এবং ইহার উদ্যোগ আয়োজন করিতে কঠোর পরিশ্রম করেন। এজন্য তাঁহার প্রায় ৪ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। সুদক্ষ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় টাটা কারখানা স্থাপনের উপযোগী স্থান নির্বাচন করেন। এই স্থানের সন্নিকটেই লোহার খনি এবং কয়লা ও চুনা পাথরও ইহার নিকটে পাওয়া যায়।

 তিনি ইংলণ্ড ও জার্মানীতে স্থানীয় খনিজ লৌহ ও কয়লার নমুনা পরীক্ষা করান এবং জীবনের অপরাহ্ণে ক্লেশ স্বীকার করিয়া জার্মানী ও আমেরিকাতে গিয়া তথাকার লোহা ও ইস্পাত শিল্প সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। টাটার পরবর্তিগণ এই স্কীম কার্যে পরিণত করিবার জন্য কি করিয়াছিলেন, তাহার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নাই। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, ১৯০৮ সালে সাক্‌চীতে কারখানা নির্মাণ কার্য আরম্ভ হয় এবং ১৯১১ সালের ২রা ডিসেম্বর সর্ব প্রথম ঐ কারখানাতে লৌহ তৈরী হয়। যুদ্ধের সময়ে টাটার কারখানা দেশ ও গবর্ণমেণ্টের জন্য খুব কাজ করিয়াছিলেন। তাঁহারা প্রমাণ করেন বাহির হইতে কোন অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের আমদানী যখন বন্ধ হয়, তখন স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান সে অভাব কিরূপে পূরণ করিতে পারে

 কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র, জার্মানী ও বেলজিয়ম ভারতের বাজার সস্তা দরের ইস্পাতে ছাইয়া ফেলিল। টাটার কারখানার ইস্পাত উহার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পারিল না। কোম্পানীর অস্তিত্ব রক্ষা করিবার জন্য আমদানী ইস্পাতের উপর শুল্ক বসাইতে হইল। ইহার মধ্য হইতে প্রায় ১ ১/২ কোটী টাকা দুই বৎসরে টাটার কারখানার সাহায্যার্থে দেওয়া হইয়াছে। ইহার অর্থ, টাটার লোহা ও করোগেট টিনের জন্য প্রত্যেক দরিদ্র করদাতাকে শতকরা ১২ ১/২ টাকা অতিরিক্ত দিতে হইতেছে।[]

 টাটার লোহার কারখানা, তাহাদের বিপুল মূলধন, যথেষ্ট প্রাকৃতিক সুবিধা, সুশিক্ষিত বিশেষজ্ঞগণ—সত্ত্বেও যদি গবর্ণমেণ্টের সাহায্য ব্যতীত বাজারে প্রতিযোগিতা করিতে অক্ষম হয়, তবে ভারতের অন্যান্য স্বদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কিরূপ, তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।

(৪) বিশেষজ্ঞের জ্ঞান বনাম ব্যবসা

 কিন্তু ভারতে বিজ্ঞান ও শিল্প বিদ্যার উন্নতির পথে গুরুতর বাধা—অন্য প্রকারের। আমাদের জাতীয় চরিত্রে, বিশেষতঃ বাঙালীদের চরিত্রে শিল্প ব্যবসায়ে প্রবৃত্ত হইবার অনিচ্ছা মজ্জাগত। ইয়োরোপ ও প্রাচীন ভারতে ধাতুশিল্প, রঞ্জনবিদ্যা প্রভৃতি সংসৃষ্ট রাসায়নিক প্রণালী, বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমূহ জ্ঞাত হইবার বহু পর্বেই অভিজ্ঞতাবলে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। মৎপ্রণীত ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’ গ্রন্থে আমি ইহার কতকগুলি প্রধান প্রধান দৃষ্টান্ত দিয়াছি। ইস্পাত-নির্মাণ শিল্প ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রসিদ্ধ ডামাস্কাসের ইস্পাত এই প্রণালীতেই তৈরী হয়। ভারতে প্রায় হাজার বৎসর ধরিয়া


  1. ইহা ৪।৫ বৎসর পূর্বে লিখিত। পরবর্তী সময়ে, ‘ইম্পিরিয়াল প্রেফারেন্স’ বা সাম্রাজ্য বাণিজ্য শুল্কের নীতি অনুসারে টাটার কারখানা বৎসরে ৮০ লক্ষ টাকা বা তাহারও বেশী ‘রয়াল্‌টি’ পাইতেছে।