পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২২
আত্মচরিত

শিক্ষিত যুবক তৈরী হইবে, তাহারা দেশের শিল্পোন্নতিতে সহায়তা করিবে”—লর্ড মেলচেট এই নীতির সমর্থক ছিলেন।—Journal of Chemical Society, 1931.

 লর্ড মেলচেটের মন্তব্য ইয়োরোপ ও আমেরিকার শিল্প ব্যবসায়গুলির সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যাইতে পারে। উহাদের অধিকাংশ প্রায় দুই শত বৎসর হইল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং এগুলির জন্য শিক্ষিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকারীর প্রয়োজন আছে। বর্তমান রং শিল্পের জন্য এরূপ বৈজ্ঞানিকের কাজ অপরিহার্য।

 আধুনিক রাসায়নিক শিল্প, ধাতুশিল্প, অথবা বৈদ্যুতিক কারখানাকে জগতের বাজারে প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হইতে হয়, সুতরাং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাহাদিগকে সুদক্ষ বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের কাজে নিযুক্ত করিতে হয়। ইহার অর্থ এরূপ নহে যে— মালিকদের নিজেই বৈজ্ঞানিক হইতে হইবে। তবে বর্তমান যুগে যে সেকেলে প্রণালীতে আর কাজ চলিতে পারে না, একথা বুঝিবার মত বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা তাঁহাদের থাকা চাই এবং আধুনিকতম উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রণালীর সুযোগ গ্রহণ করিবার জন্য সর্বদা সজাগ থাকা প্রয়োজন। অ্যানড্রু কার্নেগী, জে, এন, টাটা, লর্ড লেভারহিউলম্, এবং স্বরূপচাঁদ হকুমচাঁদ ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, কেননা তাঁহারা প্রথম হইতেই বিশেষজ্ঞদের সাহায্য লইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু বর্তমান কালে ব্যবসায় আরম্ভ করিবার কাজে বিশেষজ্ঞেরা সামান্য অংশই গ্রহণ করিয়া থাকেন। আমি প্রসিদ্ধ ধনী ব্যবসায়ী পিয়ারপণ্ট মরগ্যানের উক্তি পর্বেই উদ্ধৃত করিয়াছি। তিনি বলেন,—

 “আমি যে কোন বিশেষজ্ঞকে ২৫০ ডলার মূল্যে কার্যে নিযুক্ত করিতে পারি, এবং তাহার প্রদত্ত তথ্য হইতে ২৫০ হাজার ডলার উপার্জন করিতে পারি। কিন্তু ঐ বিশেষজ্ঞ আমাকে নিযুক্ত করিয়া অর্থ উপার্জন করিতে পারে না।”

 কলিকাতার নিকট একমাত্র বৈজ্ঞানিক ইস্পাত শিল্পের কারখানা স্যার স্বরূপচাঁদ হুকুমচাঁদের উৎসাহ ও বুদ্ধিকৌশলে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। স্যার হকুমচাঁদের কোন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নাই। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী এবং তিনি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাইয়াছেন। তিনি কারখানা আরম্ভ করিবার পূর্বে রসায়নবিদ্যা বা বৈদ্যুতিক ধাতুশিল্পের জ্ঞানলাভের জন্য অপেক্ষা করেন নাই।

 আমি শার্লোটেনবার্গে (বার্লিন) Technische Hochschule (শিল্প মহাবিদ্যালয়) দেখিয়াছি, জুরিচ ও ম্যান্‌চেষ্টারেও ঐরূপ প্রতিষ্ঠান দেখিয়াছি। সুতরাং এই শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানকে লঘু করিবার চেষ্টা, আমার দ্বারা সম্ভবপর নহে; কিন্তু আমার দৃঢ় অভিমত এই যে, শিল্প প্রস্তুত প্রণালীর মূলসূত্রগুলি মাত্র এইসব শিল্পবিদ্যালয়ে শেখা যায়। কিন্তু শিল্প উৎপাদনের যে কার্যকরী জ্ঞান,—কিরূপে এমন শিল্পজাত উৎপন্ন করা যায়, যাহা জগতের বাজারে প্রতিযোগিতায় বিক্রয় করা যাইতে পারে, সে অভিজ্ঞতা কেবল শিল্প ব্যবসায়ের মধ্যে থাকিয়াই লাভ করা সম্ভবপর।

 সম্প্রতি বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যাণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কসে ইহার একটি দৃষ্টান্ত আমি দেখিয়াছি। তাহাতে এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, টেকনোলজিক্যাল ইনষ্টিটিউটে লব্ধ জ্ঞান অপেক্ষা কারখানায় হাতেকলমে জ্ঞান লাভ করা অধিকতর ফলপ্রদ। কিছুদিন হইল, আমাদের একটি সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরীর যন্ত্র বসাইতে হয়। সাধারণতঃ যন্ত্রনির্মাতা কোন ইংরাজ শিল্পীকেই যন্ত্রটি বসাইবার জন্য ডাকা হইত এবং তিনি কোন বিশেষজ্ঞকে ঐ উদ্দেশ্যে পাঠাইয়া দিতেন। বিশেষজ্ঞকে অনেক টাকা পারিশ্রমিক, পাথেয় এবং হোটেলের ব্যয় দিতে হইত। ১৫ বৎসর পূর্বে আমরা একজন যুবককে কারখানার কাজে নিযুক্ত করি। তিনি তখন কেবল জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘জুনিয়র কোর্সে’