পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
২২৯

শৈশব অবস্থা এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি যাহা বহু শত বৎসরের চেষ্টায় সম্পন্ন করিয়াছে, ভারত বর্তমানে তাহা করিতে পারে না। এই কারণেই ইয়োরোপীয় মহাযুদ্ধের পর যে সব দেশীয় শিল্প ব্যবসার আরম্ভ হইয়াছিল, তাহার অনেকগুলিই উঠিয়া গিয়াছে। যে সামান্য কয়েকটি আছে, সেগুলিকেও অতি কষ্টে অস্তিত্ব রক্ষা করিতে হইতেছে। এই অবস্থা অতিক্রম করিয়া শেষ পর্যন্ত কয়টি টিকিয়া থাকিবে, তাহা বলা যায় না। বিদেশী শিল্পনির্মাতারা প্রভূত মূলধন খাটাইতেছে, সুতরাং তাহাদের উৎপাদনের খরচা যতদূর সম্ভব কম। ভারতকে শিল্প ও ব্যবসায়ক্ষেত্রে এখন সংগ্রাম করিতে হইতেছে। যদি এদেশী শিল্পনির্মাতা উৎপাদনের ব্যয় যথাসম্ভব কম করিয়া লাভ না দেখাইতে পারে, তবে বিদেশী শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাহারা টিকিতে পারিবে না।

 পূর্বোক্ত বিবরণ শ্রীযুত সেনের রিপোর্ট হইতে হুবহু গৃহীত। লেখক এখন ইহলোকে নাই, একথা স্মরণ করিয়া মন দুঃখভারাক্লান্ত হইয়া উঠে। শ্রীযুত সেন তাঁহার মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে আমার অনুরোধে এই বিবৃতি লিখিয়াছিলেন।

 উক্ত বিবরণ হইতে বুঝা যায়, কাশিমবাজারের মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এবং হেমেন্দ্রনাথ সেন এই শিশু শিল্পকে প্রায় ৩০ বৎসর যাবৎ পোষণ করিয়াছিলেন। ব্যবসায়ে মহারাজা এবং মেসার্স বি, এন, সেন এবং এইচ, এন, সেন ভ্রাতৃদ্বয়ের অংশই শতকরা ৫০ ভাগ।

 এই কোম্পানী এবং আরও কয়েকটি কোম্পানীর সঙ্গে আমি সংসৃষ্ট। এই সব কোম্পানীর অংশীদারগণ আমাকে প্রায়ই লভ্যাংশ না দিবার জন্য নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া পত্র লিখেন।[] কিন্তু পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে পাঠকরা বুঝিতে পারিবেন, শিল্প প্রবর্তকদের পথে কি প্রবল বাধা বিপত্তি ছিল। জাপানের জাতীয় গবর্ণমেণ্ট নানা শিশু শিল্প প্রবর্তন ও ঐ গুলিকে রক্ষা করিবার জন্য যে সাহায্য করিয়াছিল, তাহাই এই সব প্রশ্নের সমুচিত উত্তর।

 “জাপানে নূতন শিল্প প্রবর্তনের দায়িত্ব গবর্ণমেণ্টই গ্রহণ করিয়াছিলেন। যে সব স্থলে গবর্ণমেণ্ট প্রত্যক্ষ ভাবে কোন নূতন শিল্প প্রচেষ্টাকে মূলধন দিয়া সাহায্য করেন নাই, সে স্থলে তাঁহারা সংরক্ষণশুল্ক অথবা বৃত্তি দ্বারা শিল্পনির্মাতাকে সাহায্য করিয়াছেন অথবা সরকারী ব্যাঙ্ক হইতে তাঁহাকে ঋণ দিয়াছেন।” Allen: Modern Japan and its Problems, p. 103.


  1. কোম্পানীর জনৈক বড় অংশীদার (তাঁহার অংশের মূল্য প্রায় ৮০ হাজার টাকা) একজন ইংরাজ ভদ্রলোক ডিরেক্টর বোর্ডের জনৈক সদস্যকে লিখিয়াছেন— “L.—আমাকে অনুগ্রহ পূর্বক লিখিয়াছেন, কোম্পানীর জন্য আপনাদিগকে কিরূপ বিপদের মধ্যে পড়িতে হইয়াছে এবং আপনারা কিরূপে তাহার সম্মুখীন হইয়াছেন। আমরা, অংশীদারেরা দূর হইতে আপনাদের কৃতকার্যের জন্য নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব। আমি নিজে আপনাদিগকে অশেষ ধন্যবাদ দিতেছি। আপনারা যে শেষ পর্যন্ত সাফল্য লাভ করিবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার আছে। আমাদের বিশেষ সৌভাগ্যের বিষয় যে, আমরা আপনাকে পাইয়াছি। এমন আর একজন ব্যক্তিও নাই যাঁহার বুদ্ধি ও মহৎ উদ্দেশ্যের প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা আছে। আপনারা যদি ব্যবসায়ের অবস্থা ভাল না করিতে পারেন, তবে তাহা আশ্চর্যের বিষয় হইবে।
     এই ইংরাজ অংশীদার সরকারী কাজ হইতে অবসর গ্রহণের পর ব্যবসায়টির উন্নতির জন্য সমস্ত সময় ও শক্তি ব্যয় করিতেছেন। অ-ব্যবসায়ী হইলেও তিনি এই শিল্পটির সম্বন্ধে সমস্ত বিষয় শিক্ষা করিয়াছেন। গত দেড় বৎসর হইল, তিনি প্রত্যহ নিয়মিত ভাবে ১০টা হইতে ৬টা পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিতেছেন। পটারীর ব্যবসায়টিকে সফল করিয়া তোলাই তাঁহার একমাত্র চিন্তা। একজন অংশীদারের পক্ষে এরূপ নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিবার দৃষ্টান্ত দুর্লভ এবং সকলেরই অনুকরণযোগ্য।