পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
২৩১

 তিনি একটি স্বদেশী শিল্পের সেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছেন, এই ভাবই তাঁহার মনো সর্বদা জাগ্রত এবং ইহারই বলে কোন অবস্থাতেই তিনি নিরাশ হন নাই। বস্তুতঃ, দেশের এই শিল্পোন্নতি প্রচেষ্টা তাঁহার অত্যন্ত প্রিয় কার্য এবং ইহার জন্য তিনি অক্লান্ত ভাবে কাজ করিয়াছেন। আমি এই সব কথা লিখিতে সঙ্কোচ বোধ করিতেছি, কেন না, আমি জানি যে, শ্রীযুত বন্দ্যোপাধ্যায় নীরব কর্মী, সাধারণে নাম জাহির করিতে তিনি চাহেন না। তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত কথা প্রকাশ করিবার অধিকার আমার নাই। তবে এই পর্যন্ত আমি বলিতে পারি যে, দেশের শিল্পোন্নতি সাধনের জন্য তিনি এপর্যন্ত ৪।৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছেন এবং সেজন্য তিনি কিছুমাত্র দুঃখিত নহেন। এই সুযোগে আমি আমার আর একজন বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিতেছি। তিনি অন্য একটি কোম্পানীর ডিরেক্টর রূপে আমার সহকর্মী। তাঁহার বয়স ৭০ বৎসরের কাছাকাছি এবং তিনি ধনী লোকও নহেন। পারিবারিক দায়িত্বও তাঁহার যথেষ্টই আছে,—তৎসত্ত্বেও এই কোম্পানীকে রক্ষা করিবার জন্য তিনি প্রায় ৪০ হাজার টাকা দিয়া নিজে দরিদ্র হইয়া পড়িয়াছেন। তিনি বেশ জানেন যে, এই টাকা ফিরিয়া পাইবার আশা নাই।

(২) বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস লিমিটেড

 ১৯২১ সালে নারকেলডাঙ্গায় এক ছোট কারখানা লইয়া দি বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস লিমিটেডের কাজ আরম্ভ হয়। এই শিল্প সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে, প্রথমে খুবেই বাধা-বিঘ্ন উপস্থিত হইয়াছিল। একজন বাঙালী ভদ্রলোককে প্রথমে কাজের ভার দিবার প্রস্তাব হয়। কোম্পানীর প্রবর্তকেরা তাঁহার সঙ্গে এই সর্ত করিতে চাহিয়াছিলেন যে, তাঁহাকে কয়েক জন বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট ভারতীয় যুবককে এই কাজে শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, কেন না ইহার দ্বারা কাজের প্রসারের পক্ষে সুবিধা হইবে। কিন্তু বাঙালী ভদ্রলোকটি এই সর্ত গ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন না এবং কোম্পানীর অত্যন্ত সঙ্কট সময়ে কার্য ত্যাগ করিলেন। কোম্পানীর কাজ বন্ধ হইবার উপক্রম হইল।

 কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কোম্পানীর একজন ডিরেক্টর শ্রীযুত দ্বিজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (কলিকাতার কোন কলেজে ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপক) এই কার্যে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিলেন এবং সমস্ত বাধাবিঘ্ন অগ্রাহ্য করিয়া এনামেল শিল্প সম্বন্ধে নানারূপে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইংলণ্ড, জার্মানী ও আমেরিকা হইতে বহু গ্রন্থ আনাইয়াছিলেন। তাঁহার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে কাজ আরম্ভ করা সম্ভবপর হইল। কারখানায় তখন মাত্র ছোট একটি চুল্লী ছিল এবং গৃহস্থের ব্যবহার্য ছোট খাট বাসন পত্র, দরজার নম্বর প্লেট প্রভৃতি প্রস্তুত হইত।

 দ্বিজেন্দ্র বাবর ভ্রাতা আমার ভূতপূর্ব ছাত্র দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সেই সময়ে জাপানে ছিলেন। তিনি সেখানে এনামেল শিল্প শিক্ষা করিতে লাগিলেন এবং জাপানের কারখানা এবং জাপানের কারখানা সমূহে লব্ধ অভিজ্ঞতাবলে ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রবাবুকে নানা মূল্যবান্ পরামর্শ দিয়া সাহায্য করিতে লাগিলেন।

 শ্রীযুত দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ইহার পর জাপানে এনামেল শিল্পের উপযোগী আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন এবং ১৯২৩ সালে কলিকাতায় ঐগুলি লইয়া আসেন। কলিকাতা হইতে ১৫ ১/২ মাইল দূরে পল্‌তাতে একখণ্ড প্রশস্ত জমি ক্রয় করা হয় এবং তাহার উপরে দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কারখানা নির্মিত হয়। ভট্টাচার্য ভ্রাতৃদ্বয়ের, বিশেষতঃ দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের অক্লান্ত পরিশ্রম ও কর্মোৎসাহ বিশেষ-