পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
২৩৫

এত চাঞ্চল্য হইত না। লণ্ডন বন্দরের জাহাজ নির্মাতারা আতঙ্কসূচক চীৎকার সুরু করিয়া দিল; তাহারা প্রচার করিতে লাগিল যে, তাহাদের ব্যবসা ধ্বংস হইবার উপক্রম এবং লণ্ডনের যত জাহাজ ব্যবসায়ীদের পরিবারবর্গ না খাইয়া মরিবে।” (Taylor: History of India); লর্ড ওয়েলেসলির অভিপ্রায় ছিল যে, ভারতীয় জাহাজ পণ্য বহন করিয়া ইংলণ্ডের বন্দরে প্রবেশ করিতে পারিবে এবং এইরূপে ব্রিটিশ জাহাজগুলির সঙ্গে সমানাধিকারে বাণিজ্য করিতে পারিবে। কিন্তু ভারতীয় জাহাজ শিল্পকে উৎসাহ দেওয়ার এই উদার ও সঙ্গত নীতি, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের চীৎকারে রহিত হইল। বোর্ড অব ডিরেক্টর এবং কোম্পানীর মালিকগণ বড়লাটের এই উদার নীতির তীব্র নিন্দা করিয়া কড়া প্রস্তাব গ্রহণ করিলেন।

 বর্তমান সময়েও আমরা দেখিতেছি, যখনই বাংলা কিম্বা বোম্বাইয়ে স্বদেশী ষ্টীমার লাইন চালাইবার চেষ্টা হইয়াছে, তখনই একাধিপত্য-ভোগকারী শক্তিশালী ব্রিটিশ কোম্পানীগুলি প্রাণপণে এই সব স্বদেশী ব্যবসায়ীকে প্রারম্ভেই গলা টিপিয়া মারিতে চেষ্টা করিয়াছে। কলিকাতার ‘ইষ্ট বেঙ্গল রিভার ষ্টীমার সার্ভিস লিমিটেডের’ প্রতিনিধিরূপে, ভারতীয় পোত শিল্প কমিটির সম্মুখে শ্রীযুত যোগেন্দ্রনাথ রায় যে সাক্ষ্য প্রদান করেন, আমার কথার প্রমাণ স্বরূপ তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি:—

 “মূলধনের অভাব অথবা দক্ষ পরিচালনার অভাবে এই কোম্পানীর উন্নতি ব্যাহত হয় না। ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ীরা সকলে মিলিয়া একজোট হইয়া অবৈধভাবে এই ভারতীয় ব্যবসায়কে ধ্বংস করিতে চেষ্টা করিয়াছিল বলিয়াই ইহার অবস্থা শোচনীয় হইয়াছে। যখন এই কোম্পানী প্রথম কাজ সুরু করে, তখন অধিকাংশ পাটের কল এই কোম্পানীর জাহাজে আনীত মাল লইত এবং মালের চালানী কাগজের অগ্রিম টাকাও দিত। কিন্তু কয়েক বৎসর পরে, ইয়োরোপীয় কোম্পানীগুলি দেখিল যে এই ভারতীয় কোম্পানী জাহাজের সংখ্যা বাড়াইতেছে ও ভাল ব্যবসা করিতেছে, এবং তাহার দৃষ্টান্তে আরও নূতন নূতন ভারতীয় কোম্পানী গঠিত হইতেছে। তখন তাহারা পাটের কলের মালিকদের সঙ্গে এইরূপ চুক্তি করিল যে ভারতীয় কোম্পানীর জাহাজে আনীত মাল তাহারা গ্রহণ করিতে পারিবে না।”

 সিন্ধিয়া ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীর অভিজ্ঞতা এর চেয়েও শোচনীয়। এই কোম্পানীর উপকূল বাণিজ্যের জন্য অনেকগুলি জাহাজ আছে। এই কোম্পানীর চেয়ারম্যান শ্রীযুত বালচাঁদ হীরাচাঁদ ১৯২৯ সালের ২৫শে নভেম্বর যে বক্তৃতা করেন, তাহাতে অনেক স্পষ্ট কথা আছে: “এই কোম্পানীর জাহাজগুলি যে পথে চলাচল করে, সেখানে বিদেশী কোম্পানীগুলি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বহু জাহাজ চালাইয়া থাকে। ইহার উপর উহারা এমন ভাবে মালের ভাড়া হ্রাস করিয়াছে যে কোন ভারতীয় কোম্পানীর পক্ষে প্রতিযোগিতায় আত্মরক্ষা করা কঠিন।” ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ ভারত গবর্ণমেণ্ট ইচ্ছাপূর্বকই ভারতীয় জাহাজ শিল্প ও ব্যবসায়ের প্রতি বিরুদ্ধভাব অবলম্বন করিয়াছেন। শ্রীযুত বালচাঁদ হীরাচাঁদ এই সম্পর্কে বলিয়াছেন—“ভারতের জাহাজ নির্মাণের কারখানাগুলিই কেবল একে একে লুপ্ত হয় নাই, পরন্তু ভারতে যাহাতে সরকারী প্রয়োজনেও জাহাজ নির্মিত না হইতে পারে, তাহার জন্য গবর্ণমেণ্ট কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। ইহার ফলে বোম্বাইয়ের প্রসিদ্ধ ডকইয়ার্ড বহু বর্ষ ধরিয়া ইংলণ্ড ও ভারতের প্রয়োজনে প্রভূত কার্য করিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এইরূপে ভারতীয় পোতশিল্পের ধ্বংসযজ্ঞ সমাপ্ত হইল। যেদিন লণ্ডনে ভারতে নির্মিত জাহাজ ভারতীয় পণ্য বহন করিয়া উপস্থিত হইয়াছিল সেই দিন হইতেই ইংলণ্ডের জাহাজ নির্মাতাদের মনে