পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
একবিংশ পরিচ্ছেদ
২৩৯

তার করিয়াছিলেন। এই আইনের প্রয়োজনীয়তা বুঝাইতে গিয়া তাঁহারা কয়েকটি দৃষ্টান্তও প্রদর্শন করিয়াছিলেন। নবগঠিত স্বদেশী কোম্পানী ‘বেঙ্গল বর্মা ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানী লিমিটেডের’ জাহাজ চট্টগ্রাম ও রেঙ্গুনের মধ্যে যাতায়াত করিতেছিল। কিন্তু বিদেশী জাহাজ কোম্পানীগুলি অত্যধিক ভাড়া কমাইয়া এই দেশীয় জাহাজ কোম্পানীর সঙ্গে অবৈধ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। ১৯০৫-৬ সালের স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোং লিমিটেড বিদেশী জাহাজ কোম্পানীর এইরূপে অবৈধ প্রতিযোগিতায় কিভাবে উঠিয়া যায়, তাহাও সকলেই জানেন। ভারতের উপকূল বাণিজ্য ভারতীয় জাহাজের জন্য সংরক্ষিত করা একান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িতেছে। আমাদের পাঠকেরা জানেন যে, বিদেশী জাহাজ কোম্পানীগুলি বেঙ্গল বর্মা ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীকে পরাজিত করিবার জন্য চট্টগ্রাম ও রেঙ্গুনের মধ্যে তাহাদের যাত্রী ভাড়ার হার ১৪ টাকা হইতে ৪ টাকাতে নামাইয়াছিল,—এই নূতন স্বদেশী শিল্পকে ধ্বংস করিবার জন্য তাহারা এরূপ ভয়ও দেখাইয়াছিল যে, যাত্রীভাড়া তাহারা একেবারেই তুলিয়া দিবে। আর একটি বিদেশী জাহাজ কোম্পানী বেঙ্গল বর্মা ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা মৌলবী আবদুল বারি চৌধুরীর সঙ্গে আর এক দিক দিয়া অবৈধ প্রতিযোগিতা করিতেছে। চৌধুরী সাহেবের লঞ্চ এতদিন যে সব নদীতে যাতায়াত করিত, ঐ বিদেশী কোম্পানী সেই সব স্থানে তাহাদের লঞ্চ চালাইতে আরম্ভ করিয়াছে। উহার উদ্দেশ্য, বেঙ্গল বর্মা ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীর প্রধান কর্মকর্তার আর্থিক ক্ষতি যদি করা যায়, তবে তাহার ফলে, কোম্পানীটিও ফেল পড়িয়া যাইবে।”

 আমি নিজে আর একটি দেশীয় ষ্টীম ন্যাভিগেশান কোম্পানীর সহিত যুক্ত আছি। এই কোম্পানীটি ছোট। আমাদেরও ঠিক পূর্বোক্ত রূপ বাধাবিঘ্নের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। গত ২২ বৎসরে এই কোম্পানীর প্রায় ২ লক্ষ টাকা লোকসান হইয়াছে। এই কোম্পানীর লাইনের ভাড়া ছিল এক টাকা। কিন্তু একটি শক্তিশালী ব্রিটিশ কোম্পানী আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়া ঐ লাইনেই ষ্টীমার চালাইতে লাগিল এবং ভাড়া কমাইয়া মাত্র এক আনা করিল। কিন্তু কোম্পানীর ২।৩ জন ডিরেক্টর স্বদেশী শিল্পের প্রতি অনুরাগ বশতঃ সমস্ত ক্ষতি অকাতরে সহ্য করিয়াছিলেন, নতুবা কোম্পানীটি বহুদিন পূর্বেই উঠিয়া যাইত।

 হিসাব করিয়া দেখা যাইতেছে যে, গত ২৫ বৎসরে, ২০টির অধিক ভারতীয় জাহাজ কোম্পানী, একুনে প্রায় দশ কোটী টাকা মূলধন লইয়া ভারতের উপকূলে ব্যবসা চালাইতে চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু তাহাদের অধিকাংশই ব্রিটিশ কোম্পানীগগুলির ভাড়া হ্রাসের প্রতিযোগিতায় কারবার গুটাইতে বাধ্য হইয়াছে।

 ইহা হইতে দেখা যাইবে যে, ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট এই স্বদেশী শিল্পের ধ্বংস সাধনে যথাশক্তি সহায়তা করিয়াছেন। নিম্নোধৃত বিবৃতিগুলি হইতে এবিষয়ে আরও অনেক কথা জানা যাইবে।

 “কোর্টের চক্ষে সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধ হইয়াছিল, লর্ড ওয়েলেসলির ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যকে উৎসাহ প্রদানের নীতি। এই নীতির ফলে ভারতীয় বাণিজ্যপোত গড়িয়া উঠিতেছিল এবং ভারতীয় বাণিজ্যও সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাইতেছিল। কিন্তু ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী তাঁহাদের অদূরদর্শী সঙ্কীর্ণ নীতির দ্বারা চালিত হইয়া গবর্ণর জেনারেলের এই উদার নীতির মর্ম বুঝিতে পারেন নাই। এবং যদিও ব্রিটিশ পার্লামেণ্টের মন্ত্রিমণ্ডল তাঁহাকে সমর্থন করিয়াছিলেন, তথাপি কোম্পানীর কোর্ট অব ডিরেক্টরস এবং মালিকগণ