দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
চরকার বার্তা—কাটুনীর বিলাপ
গত দশ বৎসর যাবৎ আমি চরকার বার্তা প্রচার করিবার জন্য বহু পরিশ্রম করিয়াছি। অনেকে আমার এই নূতন বাতিক দেখিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন। মহাত্মা গান্ধী যেদিন চরকার বার্তা প্রচার করেন, তখন হইতেই আমি ইহার সত্য উপলব্ধি করিয়াছি। আমি নিজে ক্ষুদ্রাকারে হইলেও একজন শিল্প ব্যবসায়ী, সুতরাং প্রথমতঃ আমি এই আদিম যুগের যন্ত্রটির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশই করিয়াছিলাম। কিন্তু বিশেষ চিন্তার পর আমি বুঝিতে পারিলাম—প্রত্যেক গৃহস্থের পক্ষে এই চরকা কত উপকারী, অবসর সময়ে এই চরকায় কত কাজ হইতে পারে। ভারতের যে সব লক্ষ লক্ষ লোক অতি কষ্টে অনশনে অর্দ্ধাশনে জীবন যাপন করে, তাহাদের পক্ষে এই চরকা জীবিকার্জনের একমাত্র গৌণ উপায়। চরকাকে দরিদ্রের পক্ষে দুর্ভিক্ষের কবল হইতে আত্মরক্ষার উপায় বলা হইয়াছে। এ উক্তি সঙ্গত। খুলনা দুর্ভিক্ষ এবং উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্পর্কে সেবাকার্যে কাজ করিবার সময় আমি বুঝিতে পারিয়াছি যে, যদি এক শতাব্দী পূর্বে চরকা পরিত্যক্ত না হইত, তবে উহা অনাহারক্লিষ্ট জনসাধারণের পক্ষে বিধাতার আশীর্বাদ স্বরূপ হইতে পারিত। এই বিষয়টি সুস্পষ্ট করিবার জন্য আমি কয়েকজন দূরদর্শী, উদারচেতা, প্রসিদ্ধ ইংরাজ মনীষীর অভিমত উদ্ধৃত করিতেছি। ইঁহারা মহাত্মা গান্ধীর অভ্যুদয়ের পূর্বেই চরকার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। কোলব্রুকের নামই সসম্মানে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।
মহাত্মা গান্ধীর জন্মের প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে এই খ্যাতনামা শাসক এবং ততোধিক খ্যাতনামা প্রাচ্য-বিদ্যাবিশারদ চরকার গুণগান করিয়াছিলেন। সংস্কৃত বিদ্যার উন্নতির জন্য হেনরী টমাস কোলব্রুক একা যাহা করিয়াছেন, তাহা আর কোন ইংরাজ করিতে পারেন নাই। তিনিই প্রথমে বেদান্তের মহান্ সৌন্দর্য পাশ্চাত্য জগতের সম্মুখে উপস্থিত করেন; তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য মনীষিগণের নিকট হিন্দুর ষড়দর্শনের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেন। তিনিই প্রথমে বহু প্রবন্ধ লিখিয়া প্রমাণ করেন যে, পাটীগণিত ও বীজগণিতে হিন্দুরাই সর্বাগ্রে পথ প্রদর্শন করিয়াছিল। কোলব্রুক ১৮ বৎসর বয়সে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে সামান্য একজন কেরাণী হইয়া ভারতে আসেন। অদম্য উৎসাহ ও অধ্যবসায়ের ফলে সংস্কৃত ভাষায় তিনি যেরূপ পাণ্ডিত্য লাভ করেন, তাহার তুলনা বিরল।
লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অল্প কাল পরে কোলব্রুক সিভিল কর্মচারী হিসাবে বাংলার সর্বত্র ভ্রমণ করেন এবং বাংলার কৃষকদের অবস্থা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৮০০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত তৎকৃত Husbandry of Bengal নামক পুস্তক খানি বহু মূল্যবান্ তথ্যে পূর্ণ।
চরকাকে দরিদ্রের সহায় রূপে বর্ণনা করিয়া তিনি বলেন,—“ব্রিটিশভারত যে সভ্য গভর্ণমেণ্ট কর্তৃক শাসিত হইতেছে, তাঁহাদের পক্ষে এদেশের অতি দরিদ্রদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করা তুচ্ছ বিষয় নহে। বর্তমানে এই প্রদেশে সাধারণের পক্ষ হইতে দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্যের কোন ব্যবস্থা নাই। যে সব বিধবা ও অনাথা স্ত্রীলোকেরা রুগ্ন বলিয়া অথবা সামাজিক মর্যাদার জন্য কৃষিক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ করিতে পারে না, তাহাদের