পক্ষে জীবিকার্জনের একমাত্র উপায় চরকায় সূতাকাটা। পুরুষেরা যখন শারীরিক অক্ষমতা বা অন্য কোন কারণে শ্রমের কাজ না করিতে পারে, তখনও স্ত্রীলোকেরা কেবল মাত্র এই উপায়েই পরিবারের ভরণপোষণ করিতে পারে। ইহা সকলের পক্ষেই সহায় স্বরূপ, এবং জীবিকার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় না হইলেও, দরিদ্রের দুর্দশা অনেকটা লাঘব করিতে পারে। যে সমস্ত পরিবার এক কালে ধনী ছিল, দারিদ্র্যের দিনে তাহাদের দুর্দশাই সব চেয়ে বেশী মর্মান্তিক হয়। গবর্ণমেণ্টের নিকট আইনতঃ তাহাদের দাবী থাকুক আর নাই থাকুক, মনুষ্যত্বের দিক হইতে তাহারা নিশ্চয়ই গবর্ণমেণ্টের সহানভূতি দাবী করিতে পারে।
“এই সমস্ত বিবেচনা করিলে বুঝা যাইবে, দরিদ্রের পক্ষে সহায় স্বরূপ এমন একটি শিল্পকে উৎসাহ দেওয়া নিশ্চয়ই উচিত। ইহা দ্বারা ব্যবসায়ের দিক হইতেও ইংলণ্ডের যে লাভ হইবে, তাহা প্রমাণ করা যায়। বাংলা দেশ হইতে তুলার সূতা, কাঁচা তূলা অপেক্ষা সস্তায় ইংলণ্ডে আমদানী করা যাইতে পারে। আয়র্লণ্ড হইতে বহুল পরিমাণে ‘লিনেন’ এবং পশমের সূতা বিনাশুল্কে ইংলণ্ডে আমদানী হয়। ইহা যদি ইংলণ্ডের পক্ষে ক্ষতিকর না হয়, তবে বাংলা হইতে আমদানী সূতার উপরে কেন অতিরিক্ত শুল্ক বসান হয়? ইহা ব্যতীত এই সূতা আমদানীর বিরুদ্ধে আরও নানা রূপ বাধা সৃষ্টি করা হইয়াছে।”
ইহার উপর মন্তব্য প্রকাশ নিষ্প্রয়োজন। ১৮০৮—১৮১৫ খৃঃ পর্যন্ত উত্তর ভারতের আর্থিক অবস্থা আলোচনা করিয়া বুকানন হ্যামিলটন একখানি বহি লিখেন। উহা হইতে কতকগুলি তথ্য আমি উদ্ধৃত করিতেছি।—
“কৃষির পরেই সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন ভারতের প্রধান জাতীয় ব্যবসা। সমস্ত কাটুনীই স্ত্রীলোক এবং জেলায় (পাটনা সহর ও বিহার জেলা) ডাঃ কাননের গণনা মতে তাহাদের সংখ্যা ৩,৩০,৪২৬। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই কেবল বিকালে কয়েক ঘণ্টা মাত্র সূতা কাটে এবং প্রত্যেকে গড়ে বার্ষিক ৭৵৮ পাই মূল্যের সূতা কাটে। সুতরাং এই সমস্ত কাটুনীদের কাটা সূতার মোট মূল্য আনুমানিক (বার্ষিক) ২৩,৬৭,২৭৭ টাকা। এই ভাবে হিসাব করিলে দেখা যায়, ইহাদের সূতার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচা তুলার মূল্য ১২,৮৬,২৭২ টাকা এবং কাটুনীদের মোট লাভ থাকে ১০,৮১,০০৫ টাকা অর্থাৎ প্রত্যেক কাটুনীর বার্ষিক লাভ গড়ে ৩৷০ আনা। কয়েক বৎসর হইতে সূক্ষ্ম সূতার চাহিদা কমিয়া যাইতেছে। সুতরাং স্ত্রীলোক কাটুনীদের বড়ই ক্ষতি হইতেছে।
“সূতাকাটা ও বস্ত্র বয়ন সাহাবাদ জেলায় প্রধান জাতীয় ব্যবসা। এই জেলায় প্রায় ১,৫৯,৫০০ জন স্ত্রীলোক সূতাকাটার কাজে নিযুক্ত আছে এবং তাহাদের উৎপন্ন সূতার মোট মূল্য বার্ষিক ১২,৫০,০০০ টাকা।”[১]
- ↑ “সব সূতাই স্ত্রীলোকেরা কাটে এবং উহা তাহাদের অবসর সময়ের কাজ”।—
“ভারতীয় মসলিন ইংলণ্ডে ১৬৬৬ সালে প্রথম আমদানী হয়। মনে রাখিতে হইবে যে, ১৮০৮ সালের ১২॥০ লক্ষ টাকা বর্তমান কালের ৫০ লক্ষ টাকার সমান।
“সাম্রাজ্ঞী নূরজাহান এদেশের শিল্পিগণকে বিশেষ উৎসাহ দিতেন এবং তাঁহারই পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাই মসলিন প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।... পরবর্তী কালেও ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি অক্ষুন্ন ছিল। এমন কি বর্তমান কালে, বয়নশিল্প ইংলণ্ডে প্রভূত উন্নতি লাভ করিলেও, ঢাকাই মসলিন এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্বচ্ছতা, সৌন্দর্য এবং সূক্ষা বুনানী প্রভৃতি গুণের উৎকর্ষে ইহা জগতের যে কোন দেশের বয়নশিল্পজাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
“পূর্বকালে ঢাকা জেলার সর্বশ্রেণীর লোকই সূতা কাটার কাজ করিত। ১৮২৪ সাল হইতে এই শিল্পের অবনতি আরম্ভ হয় এবং তাহার পর হইতে ইহা দ্রুতগতিতে লোপ পাইতেছে।