পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪৪
আত্মচরিত

 সূতাকাটা ও বস্ত্রবয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। পূর্ণিয়া জেলার সম্বন্ধে বলা হইয়াছে,— “কার্পাস বস্ত্র বয়নকারীর সংখ্যা বিস্তর এবং তাহারা গ্রামের লোকদের ব্যবহারের জন্য মোটা কাপড় বুনে। সূক্ষ্ম বস্ত্র বুনিবার জন্য সাড়ে তিন হাজার তাঁত আছে। তাহাতে ৫,০৬,০০০ টাকা মূল্যের বস্ত্র উৎপন্ন হয় এবং মোট ১,৪৯,০০০ টাকা লাভ হয় অর্থাৎ প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৮৬ শিলিং লাভ হয়। মোটা কাপড় বুনিবার জন্য ১০ হাজার তাঁত নিযুক্ত আছে এবং তাহাদের উৎপন্ন কাপড়ের মোট মূল্য ১০,৮৯,৫০০ এবং মোট ৩,২৪,০০০ টাকা লাভ হয়; অর্থাৎ প্রত্যেক তাঁতে বার্ষিক গড়ে ৬৫ শিলিং লাভ হয়।”

 রমেশ দত্ত কৃত ‘ভারতের আর্থিক ইতিহাস’ গ্রন্থ হইতে এই সমস্ত বিবরণের কিয়দংশ উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি উপসংহারে বলিয়াছেন—“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত ভারতের লোকেরা নানা শিল্প কার্যে নিযুক্ত ছিল। বস্ত্র বয়ন তখনও তাহাদের প্রধান বৃত্তি ছিল। লক্ষ লক্ষ স্ত্রীলোক সূতা কাটিয়া জীবিকার্জন করিত।”

 এইচ. এইচ. উইলসন মিল-কৃত ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের পরিশিষ্ট লিখেন। ভারতের বয়ন শিল্প কিভাবে ধ্বংস হইয়াছিল তৎসম্বন্ধে ক্ষোভের সঙ্গে তিনি নিম্নলিখিত রূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—“পরাধীন ভারতবর্ষের উপর প্রভু ব্রিটেন যে অন্যায় করিয়াছে, ইহা তাহার একটি শোচনীয় দৃষ্টান্ত। কমিশনের সাক্ষ্যে (১৮১৩ খৃঃ) বলা হইয়াছে যে, ভারতের কার্পাস ও রেশমের বস্ত্রাদি ইংলণ্ডের ঐ শ্রেণীর বস্ত্রজাত অপেক্ষা শতকরা ৫০।৬০ টাকা কম মূল্যে বিক্রয় হইত। সুতরাং ভারতীয় আমদানী বস্ত্রের উপর শতকরা ৭০।৮০ ভাগ শুল্ক বসাইয়া অথবা ঐ গুলির আমদানী একেবারে নিষিদ্ধ করিয়া ইংলণ্ডের বস্ত্রজাতকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হইল। যদি এরূপ করা না হইত, যদি এই সমস্ত অতিরিক্ত শুল্ক ও নিষেধ বিধি জারি না হইত, তবে পেইসলি ও ম্যানচেষ্টারের কল-কারখানাগুলি গোড়াতেই বন্ধ হইয়া যাইত এবং বাষ্পীয় শক্তির দ্বারাও তাহাদিগকে চালানো যাইত না। ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসস্তুপের উপর এগুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ভারত যদি স্বাধীন হইত, তবে সে প্রতিশোধ লইত, ব্রিটিশ পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাইত এবং এইরূপে নিজের শিল্পকে ধ্বংসমুখ হইতে রক্ষার ব্যবস্থা করিত। এই আত্মরক্ষার উপায় তাহাকে অবলম্বন করিতে দেওয়া হয় নাই,—তাহাকে বিদেশীর দয়ার উপরে নির্ভর করিতে হইয়াছিল। ব্রিটিশ পণ্য জোর করিয়া বিনা শুল্কে তাহার উপর চাপানো হইল এবং বিদেশী


    “ঢাকা জেলার প্রায় প্রত্যেক পরিবারই পূর্বকালে সূতা কাটিয়া উপার্জন করিত। কিন্তু সস্তার বিলাতী সূতা আমদানী হওয়াতে এই প্রাচীন শিল্প প্রায় সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হইয়াছে।
     “এইরূপে যে সূতাকাটা ও বস্ত্রবয়ন শিল্প এদেশে অগণিত লোকের অন্নসংস্থান করিয়াছে, তাহা ৬০ বৎসরের মধ্যেই বিদেশীদের হাতে চলিয়া গিয়াছে।” Taylor: Topography of Dacca.
     মোরল্যাণ্ড তাঁহার India at the Death of Akbar নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন:—
     “বাংলাদেশ নেংটি পরিয়া থাকিত, এ সিদ্ধান্তও যদি আমরা করি, তাহা হইলেও স্বীকার করিতে হইবে, বস্ত্রবয়ন শিল্প ভারতে খুবই প্রসার লাভ করিয়াছিল এবং ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ভারতের মোট উৎপন্ন বস্তুজাত শিল্প জগতের একটা প্রধান ব্যাপার ছিল। স্বদেশের সমস্ত অভাব তো পূরণ করিতই, তাহা ছাড়া বিদেশেও ভারতের বস্ত্র রপ্তানী হইত।”
     র‍্যাল্‌ফ ফিচ তাঁহার ভ্রমণবৃত্তান্তে (১৫৮৩ খৃঃ) লিখিয়াছেন:—
     “বাকোলা হইতে আমি ছিরিপুরে (শ্রীপুরে) গেলাম।... এখানে প্রচুর কার্পাস বস্ত্র উৎপন্ন হয়।
     “সিনারগাঁও (সোণারগাঁও) ছিরিপুর হইতে ছয় লীগ দূরে একটি সহর। সেখানে ভারতের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম বস্ত্র উৎপন্ন হয়।
     “এখান হইতে প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র ও চাউল রপ্তানী হইরা ভারতের সর্বত্র, সিংহল, পেগু, সুমাত্রা, মালাক্কা এবং অন্যান্য নানা স্থানে যায়।”