শিল্প ব্যবসায়ী অবৈধ রাজনৈতিক অস্ত্রের সাহায্যে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেষণ করিল,—যে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বৈধ প্রতিযোগিতায় তাহার জয়লাভের কোন সম্ভাবনা ছিল না।”
ভারতের আর একটি শিল্পও ইংরাজ এই ভাবে ধ্বংস করিয়াছেন। ভারতের তাঁতে বোনা চট ও থলে ভারতের বাহিরে নানাদেশে চালান যাইত। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দেশীয় শিল্পটির খুব প্রসার হয়। ইংলণ্ড কিরূপে এই শিল্প ধ্বংস করে, আর একটি অধ্যায়ে তাহা বিবৃত করিব।
বাংলা দেশে হাতে বোনা মোটা কাপড়ের শিল্প আমদানী বিদেশী কাপড়ের প্রতিযোগিতায় বহু দিন পর্বেই লুপ্ত হইয়াছে। অন্যান্য প্রদেশও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়াছে। কেন লোকে দিনের পর দিন কষ্ট করিয়া সূতা বুনিবে ও কাপড় তৈরী করিবে,—ল্যাঙ্কাশায়ার ও জাপান ত তাহাদের কলে তৈরী সূক্ষ্ম বস্ত্রজাত লইয়া, ঘরের দরজায় সর্বদাই হাজির আছে! বাংলার ঋণগ্রস্ত অনশনক্লিষ্ট কৃষকগণ, তোমরা তোমাদের দেশের ভদ্রলোকদের অনুসরণ করিয়া নিজেদের দুঃখকষ্ট বিস্মৃত হও! হুকা ছাড়িয়া সিগারেটের ধূম পান কর, পায়ে না হাঁটিয়া মোটর বাসে চড়, চা খাইয়া ক্ষুধা নষ্ট কর—তাহা হইলেই আহারের ব্যয় আর বেশী লাগিবে না। এবং এই সব বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিদেশী বণিকদের পকেট ভর্তি করিয়া দাও। যখন মামলামোকদ্দমা করিতে সহরে যাইবে, তখন সিনেমা দেখিতে ও টর্চলাইট কিনিতে ভুলিও না। পাঠকগণ ক্ষমা করিবেন, বড়দুঃখেই আমি এই সব কথা লিখিতেছি।
অর্থনীতি-বিদেরা আমাদের বলেন যে, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য যখন সস্তায় বিদেশ হইতে আমদানী করা যায়, তখন সেইগুলি এদেশে উৎপাদন করা—পাগলামি ভিন্ন আর কিছুই নহে, এই কারণে তাঁহারা আমাদের লপ্ত স্বদেশী পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার প্রতি বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন। বর্তমান যুগে চরকা প্রচলন করিবার চেষ্টা, আদিম যুগের কোন লুপ্ত প্রণালীকে পুনরুজ্জীবিত করিবার চেষ্টার মতই হাস্যকর। কিন্তু ইহার ভিতর একটা যে মিথ্যা যুক্তি আছে, তাহা আশ্চর্যরূপে তাঁহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যায়। বাংলার অধিকাংশ স্থানে একমাত্র প্রধান ফসল আমন ধান্য এবং রোপণ ও বোনা, কাটা সমস্ত শেষ করিতে তিন মাস মাত্র সময় লাগে। বৎসরের বাকী নয় মাস কৃষকেরা আলস্যে কাটায়। বাংলায় কোন কোন অঞ্চলে ধান ও পাট ছাড়া সরিষা, মটর প্রভৃতি রবিশস্যও হয়। কিন্তু সেখানেও কৃষকদের বৎসরের মধ্যে ৫।৬ মাস কোন কাজ থাকে না। বর্তমান পৃথিবীর কঠোর জীবন সংগ্রামে যে জাতি বৎসরের অধিকাংশ সময় স্বেচ্ছায় আলস্যে কাল হরণ করে, তাহারা বেশী দিন ধরা পৃষ্ঠে টিকিতে পারে না। ইহার পরিণাম অনশন, অর্দ্ধাশন এবং বিপুল ঋণভার—এখনই বাংলাদেশে দেখা যাইতেছে। পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত পূর্ববঙ্গে বর্ষার পর পলিমাটী পড়িয়া জমি উর্বরা হয় এবং প্রচুর ধান, পাট, কলাই, মটর প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। কিন্তু সেখানেও, কৃষকেরা মোটের উপর স্বচ্ছল অবস্থাপন্ন হইলেও, মহাজনদের ঋণজালে আবদ্ধ।[১] বস্তুতঃ, এই সকল অঞ্চলে
- ↑ কৃষকেরা যে বিনা কাজে আলস্যে কালহরণ করে, তৎসম্বন্ধে কয়েকজন লেখক মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন,—যথা: পানাণ্ডিকর—Wealth & Welfare of the Bengal Delta, p. 150। জ্যাক বলেন,—“কৃষকদের কাজের সময়ের হিসাব করিলে দেখা যায় যে, তাহারা পাট চাষের জন্য তিন মাস কাজ করে এবং ৯ মাস বসিয়া থাকে। যদি ধান ও পাট উভয় শসাই তাহারা উৎপাদন করে, তবে জুলাই ও আগস্ট মাসে আর অতিরিক্ত দেড়মাস মাত্র কাজ তাহাদের করিতে হয়।”