লোক সংখ্যা খুব বেশী হইয়া পড়িয়াছে, প্রতি বর্গ মাইলে লোক সংখ্যার পরিমাণ ৬০০ হইতে ৯০০। জমি বহু ভাগে বিভক্ত হওয়াতে ময়মনসিংহ অঞ্চল হইতে বহু বহু লোক আসামে যাইতেছে। ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি প্রভৃতি বাংলার পূর্বাঞ্চলের কৃষকেরা অধিকাংশই মুসলমান, তাহারা পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু। তাহাদের মধ্যে অনেকে জাহাজে লস্করের কাজ গ্রহণ করে। এই কারণেও লোক-সংখ্যার চাপ কিয়ৎ পরিমাণে হ্রাস হয়।
জমি উর্বরা হইলেই যে সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের অবস্থা ভাল হইবে, এমন কোন কথা নাই। বরং অনেক সময় তাহার বিপরীত দেখা যায়। এ বিষয়ে রংপুরের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই অঞ্চলের জমি খুব উর্বরা, এবং ধান, পাট, তামাক, প্রভৃতি কয়েক প্রকারের শস্য এবং শাকসব্জী এখানে উৎপন্ন হয়। কিন্তু এই জেলার অধিবাসীরা
“যতদিন পর্যন্ত তাহাদের হাতে খাদ্য ও অর্থ থাকে, ততদিন তাহারা পরকুৎসা, দলাদলি, মামলা মোকদ্দমা এই সব করিয়া কাল কাটায়।”—Burrows.
ইয়োরোপের কৃষিপ্রধান দেশসমূহে কৃষকেরা অবসর সময়ে (যে সময়ে চাষের কাজ না থাকে) কি করে, তাহার বর্ণনা আমাদের দেশের লোকের পক্ষে বেশ শিক্ষাপ্রদ হইবে। বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমান স্ত্রীলোকেরা পর্দানশীন, তাহারা বাহিরে যাইয়া কাজ করিতে পারে না। কিন্তু ইয়োরোপের স্ত্রীলোকেরা সমস্ত প্রকার গৃহকার্য করিয়াও অন্য নানা কাজে বেশ দুপয়সা উপার্জন করে, যথা:—“পরিবারের সকলেই অতি প্রত্যূষে উঠে এবং গরম কফি ও রুটি খাইয়া কাজে লাগিয়া যায়। কৃষক, তাহার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা এবং পুরুষ শ্রমিক প্রভৃতি ক্ষেতের কাজে যায়। এই সব ক্ষেত্রে গম, রাই, ওট, যব প্রভৃতি শস্য হয়। আলু, মটর, বিটমূল, শাকসব্জী প্রভৃতি সর্বত্রই হয়। ‘হপ’ (hop) শস্য কেবল স্বচ্ছল কৃষকেরা উৎপন্ন করে।
“স্বামী যখন ক্ষেতের কাজ করে, সেই সময়ে স্ত্রী গৃহে তাহার ঝুড়িতে মাল ভর্তি করিয়া বাজারে বিক্রয় করিতে যায়। এই ঝুড়ি প্রায় এক গজ লম্বা এবং পিঠে ঝুলানো থাকে। ঝুড়িতে শাকসব্জী, ফল, গৃহে প্রস্তুত রুটী প্রভৃতি থাকে। সহরের লোকরা এগুলি খুব আগ্রহের সঙ্গে কেনে। পিঠের ঝুড়ি যখন ভর্তি হয়, তখন একটা ছোট ঝুড়ি ভর্তি করিয়া মাথার উপরে তাহারা নেয়। এই ঝুড়িতে সময় সময় ডিম থাকে, কিন্তু প্রায়ই বাজারে বিক্রীর জন্য মুরগী লওয়া হয়।
“শীতের মাঝামাঝিই কৃষকদের পক্ষে সুখের সময়। এই সময়ে তাহারা ক্ষেতের কাজ করিতে পারে না, ঘরে বসিয়াই বাসনপত্র মেরামত করে, কিছু ছুতারের কাজ করে, কাস্তে, কোদাল, ছুরি, করাত প্রভৃতি ধার দেয়। স্ত্রীলোকেরা সূতাকাটা, কাপড় বোনা ও কারুসূচীর (এমব্রয়ডারীর) কাজ করে।
“কেবল পুরুষেরা নহে, স্ত্রীলোকেরাও আশ্চর্যরকমের ভারবহন ক্ষমতার পরিচয় প্রদান করে। মাথার প্রকাণ্ড বোঝা লইয়া সোজাভাবে তাহারা পাহাড়ের উপর দিয়া চলিয়া যায়। বোঝা ভারী হইলে সময়ে সময়ে পিঠেও বহন করে। কোনো কোনো সময়ে আবার এই বোঝার উপরে ছোট শিশুকেও দেখা যায়। যাযাবর রমণীদের মত তাহারা শিশুকে সঙ্গে লইয়া চলে, চলিতে চলিতে তাহাকে স্তন্য পান করায়।
“ফ্রিউলির অধিবাসীদের মধ্যে যাযাবর প্রবৃত্তি বেশ লক্ষ্য করা যায়। এখানকার স্ত্রীলোকেরা ৩।৪ বা ৫।৬ জনে দলবদ্ধ হইয়া সমস্ত ইটালী ঘুরিয়া জিনিষ বিক্রয় করে। সঙ্গে ঝুড়ির ভিতরে অথবা পিঠের সঙ্গে থলিয়ায় বাঁধা অবস্থায় তাহাদের শিশু থাকে। পেয়ালা, সূতা, সেলাইয়ের বাক্স, গৃহস্থের প্রয়োজনীয় নানারূপ কাঠের বাসনপত্র এই সব তাহারা বিক্রয় করে। এগুলি পুরুষেরা শীতকালে ঘরে বসিয়া তৈরী করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই দীর্ঘ ভ্রমণকালে কোন কোন সময়ে তাহারা মাসের পর মাস ভ্রমণ করে এবং ইটালীসীমান্তও অতিক্রম করে—কোন পুরুষ তাহাদের সঙ্গে থাকে না। এই সব কষ্টসহিষ্ণু, কর্মঠ স্ত্রীলোকেরা স্বাধীনভাবেই নিজেদের ছোটখাট ব্যবসা চালায়।” Life of Benito Mussolini by Margheritta G. Sarfatti.
মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রদেশের সর্বত্র এবং যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও পাঞ্জাবেও, কোন কোন শ্রেণীর কৃষক রমণীরা ক্ষেতের কাজে পুরুষদের সাহায্য করে।