অবলম্বন করে এবং এইরূপে জমির উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কিন্তু বাংলার কৃষকেরা অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। একদিকে কৃষিকার্যে সেকেলে মান্ধাতার আমলের প্রণালী[১] অবলম্বন করিয়া, অন্যদিকে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিলাস ভোগ করিতে গিয়া, তাহারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।[২] সাগর সঙ্গমের নিকটবর্তী বদ্বীপ অঞ্চল ব্যতীত ভারতের অন্য সর্বত্র জমির উর্বরতা হ্রাস পাইতেছে, তাহার লক্ষণ স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। ষাট বৎসর পূর্বে আমার বাসগ্রাম ও তন্নিকটবর্তী অঞ্চলে রবিশস্য এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ হইত। জমি কিছুকাল পতিত রাখিতে দেওয়া তো হয়ই নাই, কোনরূপ সার দেওয়ার ব্যবস্থাও নাই। বৎসরের পর বৎসর একই জমিতে একই প্রকার শস্য উৎপাদন করা হয়। ফলে জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হয়, ফসলের পরিমাণ কম হয় এবং ফসলের উৎকর্ষও হ্রাস পায়। সরকারী কর্মচারী প্রভৃতির ন্যায় যাহারা কেবল বাহির হইতে দেখে, তাহারা বলে যে, দেশে আমদানী পণ্যের পরিমাণ বাড়িতেছে, অতএব বুঝা যাইতেছে যে, কৃষকদের অবস্থা পূর্বের চেয়ে ভাল হইতেছে। যাহারা অনশনে বা অর্দ্ধাশনে থাকে, ঋণজালে জড়িত, জমিতে ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা যাহাদের হ্রাস পাইতেছে, তাহারা যদি বিদেশী পণ্যের মোহে মুগ্ধ হয়, তাহা হইলে আর্থিক হিসাবে তাহারা আত্মহত্যাই করে। ‘শ্বেতাঙ্গদের শিল্পজাত’ বিদেশী বস্ত্রের তথা নানারূপ বিদেশী দ্রব্যের প্রতি তাহাদের মোহের ফলে ভারতীয় কৃষকদের অবস্থা, বিষধর সর্পের (rattle snake) মোহিনী শক্তিতে আকৃষ্ট পক্ষীর মত হইয়া দাঁড়ায়—এই মোহ তাহাদিগকে ধ্বংসের মুখেই টানিয়া লইয়া যায়।
- ↑ ডাঃ ভোয়েলকার বলেন,—“তাহারা যে উপযুক্ত পরিমাণে ফসল উৎপাদন করিতে পারে না, তাহার প্রধান কারণ—জলসরবরাহ এবং সারের অভাব।” এ বিষয়ে ডাঃ ভোয়েলকারের সঙ্গে আমি একমত হইলেও, আমার পূর্বোল্লিখিত কথাগুলির কোন ব্যত্যয় হয় না। সম্প্রতি সারণ, মীরাট প্রভৃতি স্থানে আমি ভ্রমণ করিয়া আসিয়াছি। সেখানে উৎপন্ন ইক্ষুর শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া আমার চোখে জল আসিল। যে ভাবে ইক্ষু হইতে রস নিঙড়ানো ও তাহা জাল দিয়া গুড় করা হয়, তাহাও অতি আদিম অনুন্নত প্রণালীর। জাভার ইক্ষু চাষীরা যে বৈজ্ঞানিক কৃষিপ্রণালী অবলম্বন করিয়া এবং উন্নত প্রণালীতে গুড় প্রস্তুত করিয়া এদেশের ইক্ষুচাষীদিগকে পরাস্ত করিবে, তাহা আর বিচিত্র কি?
- ↑ “আমেরিকার রেড-ইণ্ডিয়ানেরা যখন বন্যপ্রদেশের একমাত্র অধিবাসী ছিল, তখন তাহাদের অভাব অতি সামান্য ছিল। তাহারা নিজেরা অস্ত্র তৈরী করিত, স্রোতস্বিনীর জল ব্যতীত অন্য পানীয় খাইত না এবং পশুচর্ম দিয়া দেহ আচ্ছাদন করিত এবং ঐ পশুর মাংস খাইত।
“ইয়োরোপীয়েরা উত্তর আমেরিকার এই আদিম অসভ্য জাতিদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র, মদ্য এবং লৌহ আমদানী করিল। তাহাদের পশুচর্মের পোষাকের পরিবর্তে কলের বস্ত্রজাত যোগাইল। এইরূপে তাহাদের রুচির পরিবর্তন হইল, কিন্তু তদনুরূপ শিল্পজ্ঞান তাহাদের ছিল না, কাজেই শ্বেতাঙ্গদের প্রস্তুত পণ্যই তাহারা ক্রয় করিতে লাগিল। কিন্তু এই সব পণ্যের পরিবর্তে বন্যজাত ‘ফার’ (পশুলোম) ছাড়া আর তাহাদের কিছু দিবার ছিল না। সুতরাং কেবল নিজেদের জীবনধারণের জন্য নয়, ইয়োরোপীয় পণ্য ক্রয় করিবার নিমিত্তও তাহাদিগকে বনজঙ্গল ঢুড়িয়া পশুহননে প্রবৃত্ত হইতে হইল। এইরূপে রেড-ইণ্ডিয়ানদের অভাব বাড়িতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের স্বাভাবিক বন্যসম্পদ ক্ষয় হইতে লাগিল।
“আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলবাসী ইণ্ডিয়ানদের পরিবারের খাদ্য সংগ্রহ করিবার জন্য অত্যধিক পরিশ্রম করিতে হয়। দিনের পর দিন শিকার অন্বেষণ করিয়া তাহাদের ব্যর্থ হইতে হয়, এবং ইতিমধ্যে তাহাদের পরিবারবর্গ গাছের বাকল, শিকড় প্রভৃতি খাইয়া জীবনধারণ করে অথবা অনাহারে মরে। তাহাদের চারিদিকে অভাব, দৈন্য ও দুর্দশা। প্রতি বৎসর শীতকালে তাহাদের অনেকে না খাইয়া মরে।” De Tocqueville—Democracy in America, p. 401.
উপরে উদ্ধৃত বর্ণনার রেড-ইণ্ডিয়ানদের জীবনের এক শতাব্দী পূর্বেকার চিত্র পাওয়া যায়। রেড-ইণ্ডিয়ানেরা এখন প্রায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বাঙালী কৃষকেরাও এইভাবে ধ্বংসের মুখে চলিয়াছে।