এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
২৪৯
আধুনিক সভ্যতার জয়যাত্রার ফলে, লক্ষ লক্ষ কাটুনী, তাঁতি, ছুতার, কামার, মাঝি মাল্লা, গাড়োয়ান প্রভৃতি যে কিরূপে নিরন্ন হইয়া পড়িয়াছে, তাহার অধিক বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই।[১]
- ↑ “ভারতে বিশুদ্ধতম লৌহ এবং উৎকৃষ্ট ইস্পাত ছিল। তাহার নিদর্শনস্বরূপ এখন যে সব স্তম্ভ, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি আছে, তাহা বর্তমান ধাতুশিল্পীদের পক্ষে ঈর্ষার বস্তু। দেশীয় লৌহশিল্প যেভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা ভাবিলে মন বিষাদভারাক্লান্ত হইয়া উঠে। লোহার সম্প্রদায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কর্মকারেরাও ক্রমশঃ ক্ষয় পাইতেছে। কেবলমাত্র রাজারাই অস্ত্রশস্ত্র বর্মাদি তৈরী করাইবার জন্য কত লোক নিযুক্ত করিতেন। দরজার কব্জা, শিকল, তালা প্রভৃতি তৈরী করিবার কত কারখানা ছিল। প্রাচীন শিল্পগুলি লুপ্ত হইয়া যাওয়াতেই জমির উপর এই অত্যধিক চাপ পড়িয়াছে। চলাচলের যানবাহনাদির কথাই দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক। স্থলপথে ও জলপথে পণ্য বহন করিবার জন্য কত অসংখ্য লোক নিযুক্ত ছিল। রথ, গাড়ী এবং নৌকা তৈরী করিয়া লক্ষ লক্ষ লোক জীবন ধারণ করিত। বাষ্পচালিত যান এবং মোটর গাড়ী প্রভৃতি এখন সুদূর নিভৃত পল্লীতেও প্রবেশ করিয়াছে।”—জে. সি. রায়, কলিকাতা রিভিউ, অক্টোবর, ১৯২৭।
“পাশ্চাত্য সভ্যতা এই জাতির স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও শ্রমবিভাগ রীতির উপর সহসা আক্রমণ করাতে যত কিছু আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়াছে, সমাজের শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে এবং তাহার পুনরুদ্ধার করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। চারিদিক হইতে আমরা ইহারই প্রমাণ পাইতেছি। একদিকে কৃষকদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িতেছে এবং জমির উপর অত্যধিক চাপ পড়িতেছে, অন্যদিকে আধুনিক ধনতন্ত্র ও কলকারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরাস্ত শিল্পীরা আর্থিক ধ্বংসের মুখে চলিয়াছে, এবং ইহার ফলে নানা রোগ ও মৃত্যুর হার বাড়িয়া যাইতেছে। বাংলার সমতল ভূমিতে বদ্বীপ অঞ্চলে প্রাচীন জলনিকাশ ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হইয়াছে, তাহার উপর রেলওয়ে বাঁধ ও রাস্তা প্রভৃতি অবস্থা আরও সঙ্গীন করিয়া তুলিয়াছে। আর এই সকলের ফলে যে দেশ একদিন সুখ শান্তি ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ ছিল, তাহাই এখন দারিদ্র্য ও ম্যালেরিয়ার আবাসভূমি হইয়া উঠিয়াছে।”— স্যার নীলরতন সরকার; এই বিখ্যাত চিকিৎসক রোগের নিদান যথার্থই নির্ণয় করিয়াছেন।
“অনেকেই এখন রেলওয়ের আশ্রয় নেয়। বাঙালী মাঝিমাল্লার মুখে শুনিয়াছি, এই কারণে তাহাদের এক বিষম ক্ষতি হইয়াছে। তাহারা বলে, পূর্বে কোন কোন ভদ্রলোক পরিবারবর্গসহ কাশী, প্রয়াগ বা অন্য কোন তীর্থস্থানে যাইতে হইলে নৌকা ভাড়া করিতেন এবং এইরূপ ভ্রমণে কয়েক সপ্তাহ, এমন কি কয়েক মাসও লাগিত। কিন্তু এখন তাঁহারা রেলগাড়ীতে উঠেন এবং গন্তব্য স্থানে যাইতে একদিন মাত্র সময় লাগে।” বেভারিজ: বাখরগঞ্জ, ১৮৭৬।
বিদেশী পণ্য ও বিলাসদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরকারী আদেশের দৃষ্টান্ত।
“সাংহাই (চীন) জেলা গবর্ণমেণ্ট ১লা আগষ্ট তারিখে হুকুম জারী করেন যে, চীনাদিগকে কেবলমাত্র দেশজাত পণ্য ব্যবহার করিতে হইবে এবং বিদেশী বিলাসদ্রব্য ত্যাগ করিতে হইবে। হুকুমনামায় আরো লিখিত ছিল যে, চীনা শিল্পব্যবসায়ীদিগকে তাহাদের উৎপন্ন পণ্যের মূল্য হ্রাস করিতে হইবে এবং প্রস্তুতপ্রণালীর উন্নতি করিতে হইবে।”—The China Weekly Review, Aug. 9, 1930.
জাতীয় গঠনকার্যে নিযুক্ত চীনা ছাত্রেরা দেশজাত বস্ত্রাদি পরিতে বাধ্য।
“ন্যান্কিংএর শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তর হইতে ১৬ই মে তারিখে দেশের সমস্ত সরকারী বিদ্যালয়ে এই আদেশ জারী করা হয় যে, সমস্ত ছাত্রদিগকে বস্ত্রনির্মিত ইউনিফরম বা উর্দি পরিতে হইবে এবং ঐ সমস্ত বস্ত্র যতদূর সম্ভব দেশজাত হওয়া চাই।”—The China Weekly Review, May 24, 1930.
চীনা শ্রমিকেরা নূতন সুইডিশ দেশলাই কারখানার বিরুদ্ধে আপত্তি জানাইয়াছে।
“সাংহাইয়ের চৌকাডু নামক স্থানে ‘সুইডিশ ম্যাচ ট্রাস্ট’ কর্তৃক একটি বড় দেশলাইয়ের কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব হয়। ইহার ফলে চীনা শ্রমিকদের মধ্যে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত হয়। ‘সাংহাই জেনারেল লেবর ইউনিয়ন প্রিপারেটারি কমিটি’—তারযোগে একটি ঘোষণাপত্রে গবর্ণমেণ্ট ও দেশবাসীর নিকট আবেদন করেন যে, চীনদেশে বিদেশিগণ কর্তৃক দেশলাইয়ের কারখানা স্থাপন বন্ধ করা হোক এবং দেশীয় দেশলাই শিল্পকে রক্ষা করা হোক।”—The China Weekly Review, June 28, 1930.