পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫০
আত্মচরিত

 ১৮৮০ সালে স্যার জন বার্ডউড ভারতীয় ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের লক্ষ্য করিয়া লেখেন যে, তাঁহারা যেন কখন ভারত-জাত বস্ত্রে প্রস্তুত পোষাক ছাড়া অন্য কিছু না পরেন এবং ইহা তাঁহাদের জাতীয় সংস্কৃতি ও মর্যাদাবোধের অন্যতম নিদর্শন স্বরূপ হওয়া উচিত।

 আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা হইতেই পাঠকেরা বুঝিতে পারিবেন যে, শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা এবং তাঁহাদের দৃষ্টান্তে কিয়ৎপরিমাণে কৃষকেরাও যদি ইয়োরোপীয়দের জীবনযাত্রা প্রণালী অনুকরণ করে এবং তাহার ফলে বিদেশী পণ্যের প্রচুর আমদানী হইতে থাকে, তবে উহাতে দেশের শ্রীবৃদ্ধির লক্ষণ প্রকাশ পায় না বরং তাহার বিপরীতই বুঝায়। দেশে যে খাদ্য উৎপন্ন হয়, তাহা সমগ্র লোক সংখ্যার পক্ষে যথেষ্ট নহে, তৎসত্ত্বেও বিদেশী বিলাসদ্রব্যের আমদানী বাড়িয়া চলিয়াছে! আমাদের অর্থনীতিবিদেরা, যাঁহারা কলেজের পড়ুয়া মাত্র, চরকার প্রতি বিদ্রূপবাণ নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। কিন্তু তাঁহাদিগকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, কৃষকেরা বৎসরের মধ্যে ছয়মাস হইতে নয় মাসকাল যখন বসিয়া থাকে, তখন তাহারা কি করিবে, তবে তাঁহারা কোনই উত্তর দিতে পারেন না। এই আলস্য ও অকর্মণ্যতার ফলে বাংলা দেশ প্রতি বৎসর যে ত্রিশ কোটী টাকা দিতে বাধ্য হয়, তাহা পূর্বে এই দেশেরই কাটুনী ও তাঁতীরা পাইত। বাংলার এই জাতীয় শিল্প ধ্বংস হওয়াতে এই টাকাটা ল্যাঙ্কাশায়ার ও জাপানী শিল্প ব্যবসায়ীদের হস্তগত হইতেছে।

 তোমার কর্ম করিবার অভ্যাস যদি নষ্ট হয়, তবে তোমার ভবিষ্যতের আর কোন আশা থাকিবে না। মনুষ্যজাতির পক্ষে ইহাই স্বাভাবিক নিয়ম। বাংলার কৃষক রমণীরা এবং ভদ্রঘরের স্ত্রীলোকেরা পূর্বে যে সময়টায় সূতা কাটিতেন ও কারুশিল্পের কাজ করিতেন, এখন সেই সময় তাঁহারা বাজে গল্পগুজব করিয়া ও দিবানিদ্রা দিয়া কাটান। রেনান বলিয়াছেন, কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি আলস্য প্রবেশ করে, তবে ফল অতি বিষময় হয়।

 “যদি দরিদ্রদের বলা যায় যে, কোন কাজ না করিয়াই তাহারা সুখী হইতে পারিবে, তবে তাহারা মহা আনন্দিত হইয়া উঠিবে। ভিক্ষুককে যদি তুমি বল যে, জগৎ তাহারই এবং কোন কিছু না করিয়া সে গির্জায় পুণ্যবান্ বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার প্রার্থনা অধিকতর ফলপ্রসূ হইবে, তবে সে শীঘ্রই বিপজ্জনক হইয়া উঠিবে। টাস্কানিতে মার্সিয়ানিষ্টদের আন্দোলনের সময় এইরূপ ব্যাপার দেখা গিয়াছিল। লাজারেটির শিক্ষার ফলে, কৃষকগণ কর্মের অভ্যাস ত্যাগ করিয়াছিল, সাধারণ জীবন-যাত্রার কাজ করিতেও তাহারা অনিচ্ছা প্রকাশ করিত। ফ্র্যান্সিস অব আসিসির সময়ে গ্যালিলি ও আমরিয়াতে লোকে কল্পনা করিত যে, দারিদ্র্য দ্বারা তাহারা স্বর্গরাজ্য জয় করিতে পারিবে। এইরূপে কল্পনা ও স্বপ্নের ফলে তাহাদের পক্ষে স্বেচ্ছায় জীবন যাত্রার কাজ করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছিল। এরূপ অবস্থায় কর্মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া অপেক্ষা লোকের পক্ষে সাধু সাজিবার আগ্রহ হওয়াই স্বাভাবিক। তখন দৈনন্দিন কর্ম তাহার পক্ষে বিরক্তিকরই মনে হইবে।”— রেনান: মার্কাস অরেলিয়াস।

 বোম্বাইয়ে কাপড়ের কলগুলিতে বড় জোর ৩।৪ লক্ষ লোকের কাজ জুটিতে পারে, হুগলী তীরবর্তী পাটের কলগুলি সম্বন্ধেও সেই কথা বলা যায়। কানপুরের মিলে হয়ত আরও ২ লক্ষ লোক কাজ পাইতে পারে। এইভাবে, ভারতের কলকারখানার কেন্দ্রস্থলগুলিতে বড় জোর ২০ লক্ষ লোক জীবিকা অর্জন করিতে পারে। কিন্তু বাকী ৩১ কোটী ৮ লক্ষ লোক কি করিবে? এই দেশে ম্যানচেষ্টার, লিভারপুল, গ্লাসগো, প্রভৃতির মত কল কারখানা পূর্ণ বড় বড় সহর কবে গড়িয়া উঠিবে এবং বাংলার গ্রাম হইতে