“এই দুঃখময় পুরীতে, সমাজের বিধি ব্যবস্থা, দয়া ও সহানুভূতির বাহিরে শিশুদের গলা টিপিয়া মারা হয়, জরাজীর্ণ বৃদ্ধেরা পথে পরিত্যক্ত হয়, দুর্বল নিপীড়িত হয়, বিকৃত মস্তিকদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন হয়। তরুণেরা কলুষিত হয়। এই জনবহুল দরিদ্র বস্তীতে স্ত্রীলোকদের আঁতুড় ঘরেই প্রতারক ও গুণ্ডারা জুয়া খেলে, হল্লা করে। একদিকে মুমূর্ষুরা বাঁচিবার জন্য আঁকুপাঁকু করে, অন্যদিকে চোরেরা নেশা খাইয়া মারামারি করে। শিশুরা খেলা করে, কলরব করে; অন্যদিকে গণিকারা মদ খায়, মাতলামি করে। এই পাতালপুরীতে শ্রেণিভেদ নাই, জাতিভেদ নাই। সকলেই এক ভাষায় কথা বলে, নর্দমা ও আস্তাকুঁড়ের ভাষা। চীনাম্যান, শ্বেতাঙ্গিনী, তরুণ তরুণী, নিগ্রো, জিপ্সী, জাপানী, মেক্সিকোবাসী, নাবিক, ভবঘুরে, পলাতক, নৈরাজ্যবাদী, বন্দুকধারী ডাকাত, ভিক্ষুক, গাঁটকাটা জুয়াচোর, গুপ্ত ব্যবসায়ী—সকলেই এখানে বন্ধু।
“সুতরাং দেখা যাইতেছে, যান্ত্রিক সভ্যতা ও ‘র্যাশনালিজেশান্’[১] উভয় মিলিয়া পৃথিবীকে দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। যথা,—যুক্তরাষ্ট্রের গবর্ণমেণ্টের সম্মুখে বিষম সমস্যা, তাহার বাজেটে ২০ কোটী ডলার ঘাট্তি। ১৯৩০ সালে অক্টোবর মাসে যত মোটর যান তৈরী হইয়াছে, এবৎসর (১৯৩১) অক্টোবর মাসে তাহা অপেক্ষা শতকরা ৪০ ভাগ কম হইয়াছে, এবং এ বৎসরের প্রথম দশ মাসে ১৯৩০ সালের তুলনায় শতকরা ২৯ ভাগ কম হইয়াছে। নভেম্বর মাসে শতকরা ৮০ ভাগ কম মোটর যান তৈরী হইয়াছে। ২৯টি কারখানার মধ্যে ১০টি একেবারে বন্ধ হইয়া গিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানী বাণিজ্য বহুল পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছে, ১৯২৯ সালে জানুয়ারী হইতে আগষ্ট পর্যন্ত উহার মূল্যের পরিমাণ ছিল ৬৮ কোটী ১০ লক্ষ পাউণ্ড, ১৯৩০ সালে ঐ সময়ে হইয়াছিল ৫১ কোটী ৯০ লক্ষ পাউণ্ড, এবৎসর হইয়াছে মাত্র ৩২ কোটী ৬০ লক্ষ পাউণ্ড। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারের সংখ্যা এক কোটীরও বেশী।
“ধনতন্ত্রের উন্মত্ততা কতদূর চরমে উঠিয়াছে, তাহার নিদর্শন,—দেশে প্রচুর কাঁচা মাল থাকিতেও মানুষ দুর্দশা ভোগ করিতেছে, না খাইয়া মরিতেছে। গম গুদামে পচিতেছে। চিনি নষ্ট করিয়া ফেলা হইতেছে। কফি সমুদ্রের জলে ফেলিয়া দেওয়া হইতেছে, ভুট্টা পোড়ান হইতেছে, তুলা পোড়ান হইতেছে। কিন্তু এই অতি-প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ খাইতে পাইতেছে না, তাহার জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক জিনিষ মিলিতেছে না। এই বিবৃতি বাস্তব ঘটনার হুবহু, চিত্র। স্থানীয় সংবাদপত্র (Deutsche Allgemeine Zeitung) সম্প্রতি ‘পৃথিবীতে ১ কোটী ১২ লক্ষ টন অতিরিক্ত গম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখিয়াছেন যে, আমেরিকাতে গম বাষ্পীয় যন্ত্রে পোড়ান হইতেছে। ব্রাজিল সব চেয়ে বেশী কফি উৎপন্ন করে,—সেই দেশে এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৫,৯৮,৭৫,২০০ কিলো কফি নষ্ট করিয়া ফেলা হইয়াছে।”—লিবার্টির বার্লিনের সংবাদদাতা, ৭ই জানুয়ারী, ১৯৩২।
ধনতান্ত্রিকতা ও কল-কারখানার পরিণাম অতি-উৎপাদনের আর একটা কুফল হয়। অতিরিক্ত মজুদ পণ্য বিক্রয়ের জন্য সিনেমা, বায়স্কোপ প্রভৃতির সহযোগে বিরাট ভাবে প্রচার করিবার প্রয়োজন হয়,—সরল প্রকৃতির কৃষকদের মনে নানা রূপে বিকৃত রুচি, কুচিন্তা ও হীন লালসার ভাব জাগ্রত করা হয়। এই প্রকার দুর্নীতিপূর্ণ মিথ্যা প্রচার কার্য দ্বারা লোকের অপরিসীম ক্ষতি হয়। জনসাধারণের মধ্যে চা’এর প্রচলন করিবার জন্য যে সব কৌশলপূর্ণ প্রচার করা হয় এবং তাহার ফলে যে ঘোর অনিষ্ট হয়, তৎসম্বন্ধে ইতিপূর্বে
- ↑ ‘র্যাশনালিজেশানের’ উদ্দেশ্য বিদেশী শিল্প-ব্যবসায়ীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষার্থ কোন দেশের শিল্প বাণিজ্যকে সংঘবদ্ধ করা।