পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
২৬৩

আমি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি। কিছুদিন হইল, ইয়োরোপে চা’এর বাজার সস্তা হওয়াতে নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যে ইহার প্রচলনের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করা হইতেছে। তাহাদের মধ্যে ৫।৬ কোটী লোক যে অসীম দুর্গতির মধ্যে বাস করে, পেট ভরিয়া খাইতে পায় না, অনাহারে থাকে, তাহাতে কি? ধনতন্ত্র নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন হীন উপায় অবলম্বন করিতে প্রস্তুত এবং হতভাগ্য দরিদ্রদের নানা প্রলোভনে ভুলাইয়া তাহারা ফাঁদে ফেলে। চা ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক, ইহা ফুসফুসের রোগ নিবারণ করে—ইত্যাদি নানারূপ অলীক যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। পাঁচ বৎসর পূর্বে জার্মানী ভ্রমণকালে আমি একটি বৃহৎ রাসায়নিক কারখানায় গিয়াছিলাম। সেখানে প্রভূত পরিমাণে কোকেন তৈরী হইতেছে দেখিয়া আমি বিস্মিত হইলাম। আরও কয়েকটি কারখানায় এইভাবে কোকেন তৈরী হয়, জাপানেও কোকেন তৈরী হইয়া থাকে। এই সব কোকেনের সবটাই ঔষধার্থ প্রয়োজন হয় না। বিশ্বরাষ্ট্রসঙ্ঘ কিছুদিন হইল গোপনে কোকেন চালান নিবারণের জন্য প্রশংসনীয় চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও পৃথিবীর নানা দেশে গোপনে কোকেন চালানীর ব্যবসা চলিতেছে। ধনতন্ত্র নির্দয়, নিষ্ঠুর, সে কেবল নিজের পকেট ভর্তি করিতে জানে।[]

 প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির পত্নী মিসেস হার্ডি নিজেও একজন লেখিকা। আধুনিক সভ্যতা সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছেন:—

 “অনেকের নিকট সভ্যতার অর্থ ধনৈশ্বর্য। যাহাদের মোটর গাড়ী আছে, টেলিফোন আছে, যাহারা প্রতি রাত্রে বেতারবার্তা শোনে, সেই সমস্ত লোকই তাহাদের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা বেশী সভ্য। যাহারা নানা প্রকারের যান্ত্রিক আবিষ্কারকে নিজেদের আমোদ প্রমোদের কাজে লাগাইতে পারে,—অধিকাংশ লোক তাহাদিগকেই সভ্য মনে করে।

 “যদি কোন ব্যক্তি এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও কল কব্জার সাহায্য গ্রহণ না করে, তবে তাহার পক্ষে উহা আত্মত্যাগের পরিচয় হইবে, সন্দেহ নাই, কিন্তু তৎসত্ত্বেও, বিবেচনা করিলে বুঝা যাইবে যে—এই সব কলকব্জা মানুষের প্রকৃত উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ। এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের জীবন কলকব্জার দাস হইয়া পড়িতে পারে, ইহাই সর্বাপেক্ষা বড় বিপদ।

 “এই বিষয়ে আলোচনা করিবার সময় আমার মন স্বভাবতঃই গান্ধীর উপদেশের প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছিল; মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় সংস্কারক—কেহ কেহ তাঁহাকে বিপ্লববাদীও বলিয়া থাকেন। এই যান্ত্রিক যুগের ঐশ্বর্যের প্রতি তাঁহার অসীম বিরাগ, কেননা মানুষের প্রকৃত সুখ ও উন্নতির পক্ষে তিনি এ সমস্তকে বাধা স্বরূপই মনে করেন। তাঁহার উপদেশ এই যে, সরল স্বাভাবিক জীবনই মানুষের আত্মাকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করে। যীশু খৃষ্টের “সার্‌মন অন্‌ দি মাউণ্ট”-এ কথিত উপদেশের সঙ্গে ইহার বহুল সাদৃশ্য আছে।

 “এক্ষেত্রে তিনি একাকী নহেন। আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান চিন্তানায়কের মুখে শুনিয়াছি যে, মানব সভ্যতার রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় প্রাচীন সহজ সরল জীবনযাত্রা প্রণালীতে প্রত্যাবর্তন করা। তিনি ইংরাজ। এই দুইজন ব্যক্তির (মহাত্মা

  1. “কৃত্রিম উপায়ে মানুষের অভাব ও প্রয়োজন সৃষ্টি করিবার জন্য বিপুল চেষ্টা করা হয় এবং এইভাবে বেকার সমস্যাকে স্থায়ী করা হয়।...... জনসাধারণকে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক শিল্পজাত ব্রুয় করাইবার জন্য নানাভাবে প্রচারকার্য চলিয়া থাকে এবং সেজন্য যথেষ্ট শক্তি ব্যয় করিতে হয়”—Demant. স্যার এ. স্লেটার এবং আরও অনেকে পণ্য বিক্রয়ের জন্য “কৃত্রিম উপায়ে মানুষের মনে নূতন নূতন অভাব সৃষ্টি করা” সম্বন্ধে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন—The Causes of War.