পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

১৮৬০ ও তৎপরবর্তী কালে বাংলার গ্রামের আর্থিক অবস্থা

 “এই ধরণের অনুসন্ধান কার্য সহরে করা যায় না। পুঁথিপত্র কাগজে এ সব সংবাদ পাওয়া যায় না। দেশের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া এ সব তথ্য জানিতে হইবে অথবা অজ্ঞই থাকিতে হইবে; দশ হাজার গ্রন্থে পরিবৃত হইয়াও কোন ফল হইবে না।” Arthur Young’s Travels.

 আর্থিক ক্ষেত্রে বাংলা দেশ কিরূপে বিজিত হইল, তাহা বুঝিতে হইলে, ১৮৬০ খৃঃ এবং পরবর্তী কালে বাংলাদেশের অবস্থা কিরূপ ছিল তাহা জানা প্রয়োজন।

 চাউল বাংলার প্রধান খাদ্য। নিরক্ষর শ্রমিকেরাও বেশী মজুরী দাবী করিতে হইলে বাজারে চাউলের দরের কথা উল্লেখ করে: “বাবু, চালের সের এক আনা, দিন দুই আনায় চার জন লোককে খাইতে দেই কিরূপে?” আমার বাল্যকালে মজুরদের মাসিক বেতন ছিল ৩॥০ টাকা কি ৪ টাকা, চাউলের মণ ছিল দেড় টাকা।[] আমাদের জেলায় মজুরেরা বেশীর ভাগ মুসলমান। তাহাদের সাধারণতঃ দুই এক বিঘা জমি থাকিত, তাহাতে ধান, শাকসব্জী প্রভৃতি হইত। বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা ছাগল, মুরগী প্রভৃতি পালন করিয়া কিছু কিছু আয় বৃদ্ধি করিত। পয়সায় কুড়িটা ভাল বেগুন পাওয়া যাইত। এক আনায় এক পুঁজি (নয়টা) গলদা চিংড়ি, টাকায় ১২টা মুরগী পাওয়া যাইত। বাজারে দুধের দর ছিল টাকায় ৩২ সের। প্রত্যেক গৃহস্থেরই গোশালা এবং ঢেঁকিশালা থাকিত; ধানের তুষ, ক্ষুদ কুঁড়া সবই কাজে লাগিত।

 বিভিন্ন রকমের ডাল গৃহস্থদের জমিতেই হইত, অথবা এক বৎসরের উপযোগী ডাল কিনিয়া বড় বড় মাটীর হাঁড়িতে রাখা হইত। প্রত্যেক গৃহস্থই এক বৎসরের খোরাকী ধান গোলায় মজুত রাখিত, তা ছাড়া অজন্মার আশঙ্কায়, আরও এক বৎসরের জন্য অতিরিক্ত ধান জমা থাকিত।

 ভাল সগন্ধি ঘৃত—আট আনা সেরে পাওয়া যাইত। বর্তমানে কলিকাতা অঞ্চল হইতে যে কলের তেল চালান হয়, গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাহার পরিচয় ছিল না। গ্রামের ঘানিতে সরিষার তেল হইত, এবং প্রত্যেক গ্রামেই উহা প্রচুর পরিমাণে মিলিত। এই খাঁটী সরিষার তেল বাঙালীর খাদ্যের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল। কলুরাই তখন বংশানুক্রমে সরিষার তেলের ব্যবস্থা করিত। সরিষার তেলের দর ছিল তিন আনা সের। তেলের খইল গরুর খাদ্য এবং জমির সার রূপে ব্যবহৃত হইত।

 গো-পালন হিন্দুর ধর্মের একটা অঙ্গ ছিল। আমার এখনও মনে আছে, আমার মা নিজে গরুর খাওয়ার তদারক করিতেন। নানা জাতির গরু আমাদের বাড়ীতে ছিল। আমাদের বাড়ীর নিয়ম ছিল যে, ছেলে মেয়েরা পাঁচ বৎসর বয়স পর্যন্ত প্রধানতঃ দুধ খাইয়া থাকিবে। ধনী ভদ্র গৃহস্থেরা এবং তাঁহাদের বাড়ীর মেয়েরা পর্যন্ত সকালবেলা গোয়ালঘর পরিষ্কার করা অপমানের কাজ মনে করিতেন না। গোয়াল ঘরের ঝাঁটালি গোবর ইত্যাদি জমিতে ভাল সারের কাজ করিত। তুষ, জাউ, কলার খোসা প্রভৃতি গরুদের খাওয়ানো


  1. নবাবী আমল—কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়।