পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
২৬৯

চিনি রপ্তানী হইল। বাংলা হইতে ইয়োরোপে কয়েক বৎসর পূর্বেই চিনি রপ্তানী সুরু হইয়াছিল। এখনও উহা রপ্তানী হইতেছে এবং এই রপ্তানীর পরিমাণ প্রতি বৎসর বাড়িয়া যাইবে ও ইয়োরোপের বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লাভ হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। ওয়েষ্ট ইণ্ডিসও এই লাভের কিয়দংশ পাইবে।

 “বেনারস হইতে রংপুর, আসামের প্রান্ত হইতে কটক পর্যন্ত, বাংলা ও তৎসংলগ্ন প্রদেশে প্রায় সকল জেলায় আখের চাষ হয়। বেনারস, বিহার, রংপুর, বীরভূম, বর্ধমান এবং মেদিনীপুরেই আখের চাষ হয়। বাংলা দেশে প্রভূত পরিমাণে চিনি উৎপন্ন হয়। যত চাহিদাই হোক না কেন, বাংলা দেশ তদনুরূপ চিনি যোগাইতে পারে বলিয়া মনে হয়। বাংলার প্রয়োজনীয় সমস্ত চিনি বাংলা দেশেই তৈরী হয় এবং উৎসাহ পাইলে বাংলা ইয়োরোপকেও চিনি যোগাইতে পারে।

 “বাংলায় খুব সস্তায় চিনি তৈরী হয়। বাংলায় যে মোটা চিনি বা দলুয়া তৈরী হয়, তাহার ব্যয় বেশী নহে—হন্দর প্রতি পাঁচ শিলিংএর বেশী নয়। উহা হইতে কিছু অধিক ব্যয়ে চিনি তৈরী করা যাইতে পারে। ব্রিটিশ ওয়েষ্ট ইণ্ডিসে তাহার তুলনায় ছয় গুণ ব্যয় পড়ে। দুই দেশের অবস্থার কথা তুলনা করিলে এরূপ ব্যয়ের তারতম্য আশ্চর্যের বিষয় বোধ হইবে না। বাংলা দেশে কৃষিকার্য অতি সরল স্বল্পব্যয়-সাধ্য প্রণালীতে চলে। অন্যান্য বাণিজ্য-প্রধান দেশ হইতে ভারতে জীবনযাত্রার ব্যয় অতি অল্প। বাংলা দেশে আবার ভারতের অন্যান্য সকল প্রদেশ হইতে অল্প। বাঙালী কৃষকের আহার্য ও বেশভূষায় ব্যয় অতি সামান্য, শ্রমের মূল্যও সেই জন্য খুব কম। চাষের যন্ত্রপাতি সস্তা। গো-মহিষাদি পশুও সস্তায় পাওয়া যায়। শিল্পজাত তৈরীর জন্য কোন বহুব্যয়সাধ্য যন্ত্রপাতির দরকার হয় না। কৃষকেরা খড়ের ঘরে থাকে, তাহার যন্ত্রপাতি উপকরণের মধ্যে, একটিমাত্র সহজ যাঁতা, কয়েকটি মাটীর পাত্র। সংক্ষেপে, তাহার সামান্য মূলধনেরই প্রয়োজন হয় এবং উৎপন্ন আখ ও গুড় হইতেই তাহার পরিশ্রমের মূল্য উঠিয়া যায় এবং কিছু লাভও হয়।” কোলব্রুক—Remarks on the Husbandry and Internal Commerce of Bengal, pp. 78—79.

 এই কথাগুলি প্রায় ১৩০ বৎসর পূর্বে লিখিত হইয়াছিল এবং যে বাংলাদেশ এক কালে সমস্ত পৃথিবীর বাজারে চিনি যোগাইত তাহাকেই এখন চিনির জন্য জাভার উপর নির্ভর করিতে হয়। উন্নত বৈজ্ঞানিক কৃষি প্রণালীর ফলে কিউবা ও জাভা এখন অত্যন্ত সস্তায় চিনি রপ্তানী করিয়া পৃথিবীর বাজার ছাইয়া ফেলিয়াছে। বর্তমানে (১৯২৮—২৯) জাভা হইতে ভারতে বৎসরে প্রায় ১৫।১৬ কোটী টাকার চিনি আমদানী হয় এবং এই চিনির অধিকাংশ বাংলা দেশই ক্রয় করে। বর্তমান সময়ে চিনি এদেশেই প্রধানতঃ প্রস্তুত হইতেছে, অতিরিক্ত শুল্ক বসাইয়া জাভার চিনি একবারে বন্ধ হইয়াছে। কিন্তু তাহাতে বাংলার কোন লাভ নাই। এই চিনি বিহার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হইতে আমদানী হয়, সুতরাং বাংলার টাকা বাংলার বাহিরে যায়।

 পাট এখন বাংলার, বিশেষতঃ উত্তর ও পূর্ব বঙ্গের প্রধান ফসল! কিন্তু ১৮৬০ সালের কোঠায় পাট যশোরে অল্প পরিমাণ উৎপন্ন হইত এবং তাহা গৃহস্থের দড়ি, বস্তা প্রভৃতি তৈরী করার কাজে লাগিত। এই সব জিনিষ হাতেই সূতা কাটিয়া তৈরী হইত। ভদ্র পরিবারের পুরুষরাও অবসর সময়ে পাটের সূতা বোনা, দড়ি তৈরী প্রভৃতির কাজ করিত। বাজারে পাটের দর ছিল ১৷০ মণ। কিন্তু পাটের চাষ ক্রমশঃ বাড়িয়া যাওয়াতে বাংলার আর্থিক অবস্থার ঘোর পরিবর্তন ঘটিয়াছে।