পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭০
আত্মচরিত

 উত্তর বঙ্গের রংপুর প্রভৃতি জেলায় “পাটের সূতা কাটা ও বোনা খুব প্রচলিত ছিল। উহা হইতে গৃহস্থের ব্যবহারোপযোগী বিছানার চাদর, পর্দা, গরীব লোকদের পরিচ্ছদ প্রভৃতি তৈরী হইত। ১৮৪০ সালের কোঠায়, কলিকাতা হইতে উত্তর আমেরিকা ও বোম্বাই বন্দরে তুলার গাঁইট বাঁধিবার জন্য চট রপ্তানী হইত; কিন্তু চিনি ও অন্যান্য জিনিষ রপ্তানী করিবার জন্য বস্তা তৈরীর কাজেই পাট বেশী লাগিত।”

 ডাঃ ফরবেশ রয়েল তাঁহার “Fibrous Plants of India” (১৮৫৫ খৃঃ প্রকাশিত) নামক গ্রন্থে হেন্‌লি নামক জনৈক কলিকাতার বণিকের নিকট হইতে প্রাপ্ত নিম্নলিখিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। এই বর্ণনা হইতে বুঝা যায়, পাট শিল্প বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্প হইয়া উঠিয়াছিল এবং এখানকার হাতে বোনা চট ও বস্তা পৃথিবীর দেশ দেশান্তরে রপ্তানী হইত।

 “পাট হইতে যে সমস্ত জিনিষ তৈরী হইত, তাহার মধ্যে চট ও চটের বস্তাই প্রধান। নিম্ন বঙ্গের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলির ইহাই সর্বাপেক্ষা প্রধান গার্হস্থ্য শিল্প। সমাজের প্রত্যেক সম্প্রদায় ও প্রত্যেক গৃহস্থই এই শিল্পে নিযুক্ত থাকিত। পুরুষ, স্ত্রীলোক, বালক, বালিকা সকলেই এই কাজ করিত। নৌকার মাঝি, কৃষক, বেহারা, পরিবারের ভৃত্য প্রভৃতি সকলেই অবসর সময়—এই শিল্পে নিযুক্ত করিত। বস্তুতঃ, প্রত্যেক হিন্দু গৃহস্থই অবসর সময় টাকু হাতে পাটের সূতা কাটিত। কেবল মুসলমান গৃহস্থেরা তুলার সূতা কাটিত। এই পাটের সূতা কাটা ও চট বোনা হিন্দু বিধবাদের একটা প্রধান কাজ ছিল। এই হিন্দু বিধবারা অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, বিনম্র, চিরসহিষ্ণু; আইন তাহাদিগকে চিতার আগুণ হইতে রক্ষা করিয়াছে বটে, কিন্তু সমাজ তাহাদিগকে অবশিষ্ট কালের জন্য অভিশপ্ত সন্ন্যাসিনী জীবন যাপন করিতে বাধ্য করিয়াছে। যে গৃহে একদিন সে হয়ত কর্ত্রী ছিল, সেই গৃহেই এখন সে ক্রীতদাসী। এই পাট শিল্পের কল্যাণেই তাহাদিগকে পরের গলগ্রহ হইতে হইতেছে না। ইহা তাহাদের অন্ন সংস্থানের প্রধান উপায়। পাট শিল্পজাত যে বাংলায় এত অল্প ব্যয়ে প্রস্তুত হয়, এই সমস্ত অবস্থাই তাহার প্রধান কারণ এবং মূল্য সুলভ হওয়াতেই বাংলার পাট শিল্পজাত সমস্ত পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে।” Wallace: The Romance of Jute.

 ইহা হইতে বুঝা যাইবে যে, হাতে তৈরী পাট শিল্প বাংলার কৃষক ও গৃহস্থদের একটি প্রধান গৌণ শিল্প ছিল। ১৮৫০—৫১ সালে কলিকাতা হইতে ২১,৫৯,৭৮২ টাকার চট ও বস্তা রপ্তানী হইয়াছিল।

 বাংলার পাট এখন চাউলের পরেই প্রধান কৃষিজাত পণ্য। কিন্তু বাঙালীদের ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যর্থতা ও অক্ষমতার দরুণ, পাট হইতে যে প্রভূত লাভ হয়, তাহার বেশীর ভাগই ইয়োরোপীয়, আর্মানী বা মাড়োয়ারী বণিকদের উদরে যায়।[]

 প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ একজন বিদেশী পাঠক হয় ত মনে করিতে পারে, ব্যবসায়ীদের এই বিপুল লাভের টাকাটা বাঙালীরাই পায়। কিন্তু তাহা সত্য নহে। কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, পাটের কল কোম্পানীগুলির অধিকাংশ অংশীদার ভারতবাসী। তাহারা ভারতবাসী বটে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙালী নয়। অবশ্য, একথা অস্বীকার করা যায় না যে, পাট বিক্রয়ের টাকার একটা প্রধান অংশ কৃষকেরাও পায়। যে সব জমিতে পূর্বে কেবল ধান চাষ হইত, সেই সব জমিতে—বিশেষভাবে ত্রিপুরা, ময়মনসিং,


  1. অনুসন্ধানে জানা যায় যে, পাটের মূল্য হইতে প্রায় ১২ই কোটী টাকা এই সব ব্যবসায়ীদের হাতে যায়।