চির অভাবগ্রস্ত হইরা ও ঋণের পাথর গলায় বাঁধিয়া, দেহ ও আত্মা কোন কিছুর উন্নতি করিতে পারিবে, এরূপ চিন্তা করাই মূর্খতা।”
১৯২৫—২৬ সালে পাটের মূল্য খুব বেশী চড়িয়া গিয়াছিল, তাহার পর দুই বৎসর পাটের মূল্য অস্বাভাবিকরূপে কমিয়া গিয়াছে। ফলে পাটচাষীদের অত্যন্ত দুর্গতি হইয়াছে। পাট চাষ অনেক স্থলে ধান চাষের স্থল অধিকার করিয়াছে। সুতরাং পূর্ব বঙ্গের চাষীরা তাহাদের খাদ্যশস্য খরিদ করিবার জন্য শতকরা বার্ষিক ২৫৲ টাকা হইতে ৩৭॥০ টাকা সুদে ঋণ করিতে বাধ্য হয়। দুর্দিনের জন্য যে সঞ্চয় করিতে হয়, এ শিক্ষা কখনও তাহাদের হয় নাই।[১] পূর্বে হঠাৎ পাটের দর চড়িয়া ধনাগম হওয়াতে পূর্ব বঙ্গের কৃষকদের মানসিক স্থৈর্য নষ্ট হইয়াছে। ফলে শিয়ালদহ ষ্টেশন ও জগন্নাথ ঘাট রেলওয়ে ষ্টেশনের গুদাম ঘর (কলিকাতায়) করোগেট টিন, বাইসাইকেল, গ্রামোফোন, নানারূপ বস্ত্রজাত, জামার কাপড় প্রভৃতিতে ভর্তি হইয়া উঠিতেছে। গ্রামবাসী কৃষকেরা এই সব খেলনা, পুতুল, সখের জিনিষ কিনিবার জন্য যেন উন্মত্ত। জাপানী বা কৃত্রিম রেশমের চাদর প্রতি খণ্ডের মূল্য ৭৲ টাকা; এদেশের সাধারণ ভদ্রলোকেরাও এগুলি ব্যয়সাধ্য বিলাসদ্রব্য বলিয়া কিনিতে ইতস্ততঃ করেন, কিন্তু এগুলি বাংলার বাজার ছাইয়া ফেলিতেছে এবং গ্রাম্য কৃষকেরা কিনিতেছে। ছেলেরা যেমন নূতন কোন রঙীন জিনিষ দেখিলেই তাহা কিনিতে চায়, আমাদের কৃষকদের অবস্থাও সেইরূপ। সুদূর পল্লীতেও জার্মানীর তৈরী বৈদ্যতিক ‘টর্চ্চ’ খুব বিক্রয় হইতেছে। তাহারা এগুলি ব্যবহার করিতে জানে না, ফলে ভিতরকার ব্যাটারী একটু খারাপ হইলেই উহা ফেলিয়া দেয়।
এদেশের কৃষকেরা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাহাদের দৃষ্টি অতি সঙ্কীর্ণ, এক হিসাবে তাহারা “কালকার ভাবনা কাল হইবে”—যীশু খৃষ্টের এই উপদেশবাণী পালন করে। তাহারা ভবিষ্যতের জন্য কোন সংস্থান করে না। ঘরে যতক্ষণ চাল মজুত থাকে, ততক্ষণ সেগুলি না উড়াইয়া দেওয়া পর্যন্ত তাহাদের মনে যেন শান্তি হয় না। মনোহর বিলাতী জিনিষ দেখিলেই তাহাদের কিনিবার প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া উঠে। বেপারীরা সর্বদাই তাহাদের কানের কাছে টাকা বাজাইতে থাকে, সুতরাং তাহারা তাহাদের কৃষিজাত বিক্রয় করিয়া ফেলিবার প্রলোভন ত্যাগ করিতে পারে না। অনেক সময় এই সব সখের বিলাতী জিনিষ কিনিবার জন্য তাহারা তাহাদের গোলার ধান প্রভৃতিও বিক্রয় করিয়া ফেলে। পূর্বে কৃষকেরা চলতি বৎসরের খোরাকী তো গোলায় মজুত রাখিতই, অজন্মা প্রভৃতির আশঙ্কায় আরও এক বৎসরের জন্য শস্যাদি সঞ্চয় করিয়া রাখিত। বর্তমানে, কৃষকদের মধ্যে শতকরা পাঁচ জনও বৎসরের খাদ্যশস্য মজুত রাখে কি না সন্দেহ, রাখিবার ক্ষমতাও তাহাদের নাই। অবশিষ্ট শতকরা ৯৫ জনই ঋণজালে জড়িত। জমিদার ও মহাজনের কাছে তাহারা চিরঋণী হইয়া আছে।
আমি বাংলার ষাট বৎসর পূর্বেকার গ্রাম্য জীবনের যে বর্ণনা করিলাম, বর্তমান অবস্থার কথা বর্ণনা না করিলে, তাহা সম্পূর্ণ হইবে না। জাতীয় আন্দোলনের ফলে উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার অনেক স্থলেই গত কয়েক বৎসর আমি ভ্রমণ করিয়াছি; খুলনা, রাজসাহী ও বগুড়ার দুর্ভিক্ষ ও বন্যা সাহায্য কার্যের জন্যও অনেক স্থলে ভ্রমণ করিতে হইয়াছে। সুতরাং বাংলার আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার আমার যথেষ্ট সুযোগ ঘটিয়াছে।
- ↑ “সাধারণতঃ, রায়তদের যখন সুযোগ ও সুবিধা থাকে, তখনও তাহারা অর্থ সঞ্চয় করিতে পারে না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ১৯২৫ সালে পাটের দর চড়া ছিল, এবং রায়তেরা ইচ্ছা করিলে ঋণ শোধ করিতে পারিত। কিন্তু তাহারা সে সুযোগ গ্রহণ করে নাই, সমস্ত টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছিল। কৃষি কমিশনের রিপোর্ট,—ভারতীয় পাটকল সমিতির সাক্ষ্য।