পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
২৭৫

তরুণেরা জাতীয় ক্রীড়া কৌতুকে যোগদান করিত। জন্মাষ্টমী উৎসবে কুন্তী, মল্লক্রীড়া প্রভৃতি হইত, কুস্তীগীরেরা তাহাতে যোগ দিত। অমৃতবাজার পত্রিকা সেই অতীত গ্রাম্য জীবনের একটি সুন্দর বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন:—

 “ম্যালেরিয়া, কলেরা ও কালাজ্বর গ্রামকে তখন ধ্বংস করিত না। দারিদ্র্য (যাহার কারণ সুবিদিত) তখন লোককে কঙ্কালসার, নিরানন্দ করিয়া তুলিত না। বিদেশী ভাষায় লিখিত পুস্তকের চাপে এবং অসঙ্গত পরীক্ষাপ্রণালীর ফলে, তরুণ বয়স্কেরা শিশুকাল হইতে এইভাবে নিষ্পেষিত হইত না। প্রত্যেক গ্রামে আখড়া ছিল এবং সেখানে লোকে নিয়মিত ভাবে কুস্তী, লাঠিখেলা, অসিক্রীড়া ও ধনুর্বিদ্যা অভ্যাস করিত; অন্যান্য শারীরিক ব্যায়ামও শিখিত। বৎসরে অন্ততঃ দুইবার—দুর্গাপূজা ও মহরমের সময়,—বড় রকমে, খেলাধূলা ও ব্যায়াম প্রদর্শনী হইত। স্ত্রী পুরুষ সকলেই সানন্দে এই উৎসবে দর্শকরূপে যোগদান করিত। আমাদের বড়লোকেরা এখন মোটর গাড়ী ও কুকুরের জন্য জলের মত অর্থ ব্যয় করিয়া আনন্দলাভ করেন। কিন্তু সেকালে স্বতন্ত্র প্রথা ছিল। বড়লোকেরা পালোয়ান ও কালোয়াতদের পোষণ করা কর্তব্যজ্ঞান করিতেন। সুতরাং পূর্বকালে ধনীদের বাসভূমি যে সঙ্গীত ও মল্লবিদ্যার কেন্দ্রস্থান ছিল, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। লোকে কালোয়াত ও পালোয়ানদের ভালবাসিত ও শ্রদ্ধা করিত।

 “বর্তমানে এই অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়াছে। পাঞ্জাব এবং যুক্তপ্রদেশের কোন কোন অঞ্চল ব্যতীত অন্যত্র পালোয়ানদের সংখ্যা অতি সামান্য। লোকে তাহাদের বড় একটা খাতিরও করে না। বাংলাদেশের অবস্থা আরও শোচনীয়। এখানে লোকের ধারণা যে, পালোয়ানেরা গুণ্ডা, এবং দারোয়ান শ্রেণীর লোকেরাই ডন বৈঠক কুস্তী প্রভৃতি করিয়া থাকে। সুতরাং বাংলার লোকেরা এরূপ অক্ষম ও দুর্বল হইবে এবং যাহারা জোর করিয়া তাহাদের ধনপ্রাণের উপর চড়াও করিবে, তাহাদেরই পদতলে পড়িবে, ইহা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নহে।”

 বাংলার গ্রামবাসী ধীবরদের মধ্যে, দুই একখানি করিয়া “মালকাঠ” থাকিত[] তাহারা মাটী হইতে এগুলিকে ঊর্ধ্বে তুলিবার জন্য সকলকে বল পরীক্ষায় আহ্বান করিত। প্রত্যেক গ্রামেই এইরূপ দুই একখানি “মালকাঠ” থাকিত। বসন্তাগমে এবং চড়ক উৎসবে যাত্রার[] দল গঠিত হইত এবং সঙ্গীত সম্বন্ধে যাহার একটু জ্ঞান থাকিত, সেই ঐ সব দলে ভর্তি হইতে পারিত। জাতিধর্মের ভেদ লোকে এ সময় ভুলিয়া যাইত। আমার বেশ স্মরণ আছে,—নিরক্ষর মুসলমান কৃষকদেরও এই সব যাত্রার দলে লওয়া হইত। আমার পিতা ভাল বেহালা বাজাইতে পারিতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামের ভাল ভাল গায়কদের নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইতেন। তাঁহার বিচারে যাহাদের গান ভাল উৎরাইত, তাহারা তাঁহার বৈঠকখানায় সসম্মানে স্থান পাইত, এবং সেখানে বসিয়া নিজেদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করিত! এখনও সেই বেহালা, সেতার প্রভৃতির সুর যেন আমার কানে ভাসিয়া আসিতেছে। স্মরণাতীত কাল হইতে বাংলাদেশে “বার মাসে তের পার্বণ” হইত এবং সর্ব প্রধান জাতীয় উৎসব দুর্গাপূজার কথা আমার এখনও মনে আছে; দুর্গাপূজা যতই নিকটবর্তী হইত, ততই লোকের মনে কি আনন্দের স্পন্দন হইত! প্রচুর পরিমাণে মিষ্টান্ন তৈরী হইত এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে বিশেষ ভাবে আমাদের প্রজাদের মধ্যে, উহা অকাতরে বিতরণ করা


  1. মল্লকাষ্ঠ বড় একটি গাছের গুঁড়ির খণ্ড বিশেষ।
  2. যাত্রা সম্বন্ধে পাঠক নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পুস্তিকা (লণ্ডন, ১৮৮২) দেখিতে পারেন।