পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৭৮
আত্মচরিত

 এই খানেই শেষ নয়। বিষ্ণুপুরের রাজার বংশধরেরা ক্রমে ক্রমে নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হইয়া যান এবং যে বিশাল রাজ্যের উপরে তাঁহারা এক কালে প্রভুত্ব করিতেন, তাহা খণ্ড খণ্ড হইয়া নূতন জমিদারদের হস্তে যাইয়া পড়ে। ১৮০৬ খৃষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজা ইহার একটি বৃহৎ অংশ ক্রয় করেন। ১৮১৯ সালের ৮নং রেগুলেশান, বিশেষভাবে বর্দ্ধমানরাজের স্বার্থরক্ষার জন্যই প্রবর্তিত হয় এবং এই রেগুলেশানের বলে বর্দ্ধমানের মহারাজা চিরস্থায়ী খাজনা বন্দোবস্তে ৩৪১টি পত্তনী তালুক ইজারা দেন। পত্তনিদারেরা আবার দরপত্তনিদারদের ইজারা দেয়। এইরূপে যে প্রথা প্রবর্তিত হয়, তাহার ফলে বাঁকুড়ার অধিবাসীরা, এবং কিয়ৎ পরিমাণে অন্যান্য জেলার লোকেরাও বহু দুঃখ ভোগ করিয়া আসিতেছে।

 বিষ্ণুপুরের রাজা বিষ্ণুপুরেই থাকিতেন এবং প্রজাদের শাসন করিতেন। তিনি হাজার হাজার বাঁধ নির্মাণ করিয়াছিলেন। বর্ষাকালে এই সব বাঁধে জল ভর্তি হইয়া থাকিত এবং গ্রীষ্মকালে জলাভাবের সময়ে তাহা কাজে লাগিত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী সর্বাপেক্ষা বড় প্রবাসী ভূস্বামী হইয়া উঠিলেন। জগতে এরূপ অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত দেখা যায় নাই। প্রসিদ্ধ ‘সূর্যাস্ত আইনের’ বলে—রাজস্ব সংগ্রহ বিষয়ে তাঁহারা নিশ্চিন্ত হইলেন। কোম্পানীর অধীনে আবার জমিদারেরা ছিলেন, তাঁহারাও জোতদারদের নিকট খাজনা আদায় সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হইলেন। প্রবাদ আছে, যাহা সকলের কাজ তাহা কাহারও কাজ নয়,—‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না’। সুতরাং যে জলসেচ প্রণালী বহু যত্নে, কৌশলে ও দূরদর্শিতার সহিত প্রবর্তিত হইয়াছিল, তাহা উপেক্ষিত ও পরিত্যক্ত হইল।

 মিঃ গুরুসদয় দত্ত বাঁকুড়ার ম্যাজিষ্ট্রেট ও কালেক্টররূপে কতকগুলি সমবায় সমিতি গঠন করিয়া ঐ জেলার কতকগুলি পুরাতন বাঁধ সংস্কার করিতে বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছেন:—

 “পশ্চিম বঙ্গে পুকুর, বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লিধ্বংসের কাহিনী ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। পশ্চিম বঙ্গের যে কোন জেলায় গেলে দেখা যাইবে, অনাবৃষ্টির পরিণাম হইতে আত্মরক্ষার জন্য জল সঞ্চয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে, সেকালের জমিদারেরা অসাধারণ দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তার সহিত—অসংখ্য বাঁধ ও পুকুর কাটিয়াছিলেন। এই বাঁধ ও পুকুর নির্মাণের জন্য বাঁকুড়াই বিখ্যাত ছিল,—একদিকে মল্লভূমির জমিদারেরা, অন্যদিকে বিষ্ণুপুরের রাজারা এই কার্যে বিশেষ রূপে উদ্যোগী ছিলেন। আবার ইঁহাদেরই বংশধরদের অদূরদর্শিতা, সঙ্কীর্ণতা, ও আত্মহত্যাকর নীতির ফলে এই সব অসংখ্য বাঁধ ও পুকুর—যাহার উপর সমগ্র জেলার স্বাস্থ্য নির্ভর করিত—ক্রমে ক্রমে ধ্বংস হইয়া গেল। ছোট ছোট খাল দ্বারা বড় বড় বাঁধগুলি পুষ্ট হইত এবং এই সব বড় বড় বাঁধ হইতে চতুর্দিকের জমিতে জল সেচন করা হইত। এই সব বাঁধে কেবল জমিতেই জল সেচন করা হইত না, মানুষ ও পশুর পানীয় জলের জন্যও ইহা ব্যবহৃত হইত।

 “পরবর্তী বংশধরেরা তাহাদের স্বাস্থ্য ও ঐশ্বর্যের উৎস স্বরূপ এই সব বাঁধ ও পুকুরকে উপেক্ষা করিতে লাগিল। তাহাদের অকর্মণ্যতা ও ঔদাসীন্যের ফলে বৎসরের পর বৎসর পলি পড়িয়া এই সব জলাধার ভরাট হইতে লাগিল, অবশেষে ঐগুলি সম্পূর্ণ শুষ্ক ভূমি অথবা ছোট ছোট ডোবাতে পরিণত হইল। চারিপাশের উচ্চ বাঁধগুলি পতিত জমি হইয়া দাঁড়াইল।”