পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
২৭৯

 অন্য এক স্থানে মিঃ দত্ত লিখিয়াছেন,—“ইহার ফলে বাঁকুড়া আজ মরা পুকুরের দেশ। বহু বাঁধ একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে; কতকগুলির সামান্য চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট আছে। কোন কোনটি পঙ্কিল জল পূর্ণ সামান্য ডোবাতে পরিণত হইয়াছে। এক বাঁকুড়া জেলাতেই প্রায় ৩০।৪০ হাজার বাঁধ, পুকুর প্রভৃতি ছিল; উপেক্ষা, অকর্মণ্যতা ও ঔদাসীন্যের ফলে ঐগুলি ধ্বংস হইয়া গিয়াছে; এবং বাঁকুড়া জেলাতে আজ যে দারিদ্র্য, ব্যাধি, অজন্মা, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ ব্যাধি প্রভৃতির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, তাহা ঐ প্রাচীন জল সরবরাহের ব্যবস্থা নষ্ট হইয়া যাইবারই প্রত্যক্ষ ফল।”

 বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গবর্ণমেণ্টকে নির্দিষ্ট রাজস্বের জন্য চিন্তা করিতে হয় না, এবং জলসেচের ব্যবস্থার ফলে জমির যদি উন্নতি হয়, তাহা হইলেও এই রাজস্ব বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা নাই। এই কারণেই জলসেচ ব্যবস্থার প্রতি শাসকগণের এমন ঔদাসীন্য। আমাদের গবর্ণমেণ্টের উদার শাসন প্রণালীতে লোকের শ্রী ও কল্যাণের মূল্য কিছুই নাই বলিলে হয়। ইহার তুলনায় সিন্ধু দেশের শুষ্ক মরুভূমির জন্য গবর্ণমেণ্টের অতিমাত্র কর্মোৎসাহ লক্ষ্য করিবার বিষয়। সুক্কুর বাঁধের স্কীমে বহুবিস্তৃত স্থানে জলসেচের ব্যবস্থা হইবে এবং উহার জন্য ব্যয় পড়িবে প্রায় ২০।২৫ কোটী টাকা। অবশ্য, স্কীমের ফলে উৎপন্ন খাদ্য শস্যের (গমের) পরিমাণ বৃদ্ধি পাইবে, কিন্তু এই স্কীমের মূলে আর একটি উদ্দেশ্য আছে। সুক্কুর বাঁধের ফলে যে জমির উন্নতি হইবে, সেখানে লম্বা আঁশযুক্ত তূলার চাষ ভাল হইবে। ল্যাঙ্কাশায়ার, তূলার জন্য আর আমেরিকার মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিতে চায় না। এই কারণে একদিকে সুদানের উপর তাহাদের বজ্রমুষ্টি নিবন্ধ হইয়াছে, অন্যদিকে ভারতের করদাতাদের কষ্টলব্ধ অর্থ বেপরোয়া ভাবে ব্যয় করা হইতেছে। এখানেও সাম্রাজ্যনীতিই প্রভাব বিস্তার করিয়াছে।

 একথা কেহই বলিবে না যে, ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট দুষ্ট বৃদ্ধির প্রেরণায় ইচ্ছা করিয়া এই উর্বরা জেলার (বাঁকুড়ার) ধ্বংস সাধন করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাদের উপেক্ষা ও ঔদাসীন্যই যে ইহার জন্য বহুল পরিমাণে দায়ী, তাহাতে সন্দেহ নাই। মিঃ দত্ত ব্যাধির মূল নির্ণয় করিতে গিয়া অর্দ্ধ পথে থামিয়া গিয়াছেন। একজন ‘ব্যুরোক্রাট’ হিসাবে স্বভাবতই তিনি এ কার্যে অক্ষমতা প্রদর্শন করিয়াছেন।

 আমাদের অর্থনৈতিক দুর্গতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সর্বত্রই জড়িত; ‘শ্বেত জাতির দায়িত্ব’ আমদানী হইবার সঙ্গে সঙ্গে এই সুন্দর বাঁকুড়া জেলা নিশ্চিতরূপে ধ্বংসের পথে গিয়াছে। প্রতিহিংসাপরায়ণ দেবদূতের পক্ষসঞ্চালনে যেমন চারিদিক শুকাইয়া যায়, ইহাও তেমনি শোচনীয় ব্যাপার। কার্যকারণ সম্বন্ধ এক্ষেত্রে স্পষ্টরূপেই প্রমাণ করা যাইতে পারে।

 আমেরিকাতে সমবায় প্রণালী যে আশ্চর্যরূপ সুফল প্রসব করিয়াছে, মিঃ দত্ত তাহার একটি চমৎকার বর্ণনা প্রদান করিয়াছেন। যথা:—

 “আমেরিকায় কৃষিকার্যে সমবায় প্রণালীর কার্যকারিতা বর্ণনা করিতে গিয়া হ্যারল্ড পাওয়েল বলিয়াছেন যে, ১৯১৯ সালে আমেরিকার সমগ্র কর্ষণযোগ্য ভূমির (১ কোটী ৪০ লক্ষ একর) প্রায় এক-তৃতীয়াংশেই সমবায় প্রণালীতে কাজ হইয়াছিল। আমার বিশ্বাস আমেরিকার জলসেচ ব্যবস্থায় সমবায় প্রণালী যে ভাবে প্রচলিত হইয়াছে, এমন আর কিছুতে নহে। আমেরিকার এই সমবায় প্রণালী পশ্চিম বঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য স্থানের পক্ষে বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। আমেরিকার সমবায় প্রণালী জলহীন মরুভূমিবৎ উটা প্রদেশের উন্নতি কল্পেই প্রথম আরম্ভ হইয়াছিল। পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারের বর্তমান অবস্থার চেয়ে উটা প্রবেশ তখন অধিকতর জলাভাব-গ্রস্ত ছিল।