“সমবায় প্রণালীই উটা প্রদেশের উন্নতির মূল কারণ একথা বলা যাইতে পারে। এই প্রণালীতে জলসেচ ব্যবস্থা এখানে যেরূপ সাফল্য লাভ করিয়াছিল, তাহার ফলে উহা অন্যান্য শিল্পেও অবলম্বিত হয়। ইহার প্রমাণ, আমেরিকাতে অসংখ্য সর ও মাখনের ব্যবসা, ফলের ব্যবসা, ষ্টোর প্রভৃতি সমবায় প্রণালীতে চলিতেছে।”
মিঃ দত্ত বাঁকুড়ার অধিবাসীদিগকে মর্মস্পর্শী ভাষায় উটার অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে বলিয়াছেন, কিন্তু তিনি ব্যাধির মূল কারণ দেখাইতে পারেন নাই; এই জায়গায় তিনি পুরোদস্তুর সরকারী কর্মচারী হিসাবে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি ইচ্ছা করিয়াই ভুলিয়া গিয়াছেন যে, উটার অধিবাসীরা অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতীয়, তাহাদের মধ্যে বহু কাল হইতে স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনির্ভরতার নীতি প্রচলিত আছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের ভাবও তাহাদের মধ্যে সুদৃঢ়। পক্ষান্তরে ভারতবাসীদের মধ্যে যাহা কিছু স্বায়ত্তশাসনের ভাব ছিল, তাহা বিদেশী শাসনের আমলে প্রাচীন গ্রাম্য পঞ্চায়েৎ ধ্বংস হইবার সঙ্গে সঙ্গে লোপ পাইয়াছে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তাহার আধুনিক অসংখ্য জোতদারী (বা পত্তনীদারী) ও দরজোতদারীর ব্যবস্থাই বাঁকুড়ার দুর্ভাগ্য ও বিপত্তির কারণ, ইহা আমি দেখিয়াছি। এই অংশ লিখিত হইবার পর আমি স্যার উইলিয়াম উইলকক্সের বহি পাঠ করিয়াছি। তিনিও বাংলাদেশের এই দুর্গতির মূল নির্ণয় করিতে গিয়া বলিয়াছেন,—
“আপনাদের ভূমি রাজস্বের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, মূলতঃ কৃষকদের মঙ্গলের জন্যই প্রবর্তিত হইয়াছিল বটে, কিন্তু উহার ফল অনিষ্টকর হইয়াছে; আপনাদের বংশপরম্পরাগত সহযোগিতার শক্তি উহাতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, জলসেচ ব্যবস্থা লুপ্ত হইয়াছে এবং ম্যালেরিয়া ও দারিদ্র্যের আবির্ভাব হইয়াছে—The Restoration of the Ancient Irrigation of Bengal, p. 24.
এই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি আরও বলিয়াছেন:—
“বাংলাদেশ এত কাল ধরিয়া সমগ্র ভারতের সাধারণ তহবিলে লক্ষ লক্ষ টাকা যোগাইয়াছে; কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ বাংলার এই দুই অংশই এই দেড়শত বৎসর ধরিয়া, গবর্ণমেণ্টের রাজধানী থাকা সত্ত্বেও অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত ও অস্বাস্থ্যকর হইয়া উঠিয়াছে। ভারতে একটা প্রবাদ আছে—‘প্রদীপের নীচেই অন্ধকার’; এক্ষেত্রে তাহা বিশেষ ভাবেই খাটে।”
এদেশে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা এবং অধিবাসীদের জন্য স্বল্প ব্যয়ে প্রচুর জল সরবরাহের উপযোগিতা মুসলমান শাসকেরা বুঝিতে পারিয়াছিলেন। আর একজন ইংরাজ লেখক তাঁহাদের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন:—
“কোন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক কি অস্বীকার করিতে পারেন যে, ১৪শ শতাব্দীর পাঠান শাসকেরা ইংরাজ আমলের বণিকরাজগণের অপেক্ষা অধিকতর দূরদর্শী, উদারনীতিক, লোকহিতপ্রবণ, এবং প্রজাদের প্রীতি ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিল? বণিক রাজগণ, আত্মপ্রশংসাতেই তৃপ্ত, প্রজাদের উন্নতিকর কোন ব্যবস্থার প্রতি তাঁহারা উদাসীন, এমন কি তৎসম্বন্ধে অবজ্ঞার ভাবই পোষণ করিয়াছেন, এবং তাঁহাদের চোখের সম্মুখে যে অপূর্ব সভ্যতা ও শিল্পৈশ্বর্য ক্রমে ক্রমে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, সেজন্য তাঁহারা বিন্দুমাত্র লজ্জা অনুভব করেন নাই। সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন এখনো বর্তমান রহিয়াছে। কিরূপে তাহা জলসেচের ব্যবস্থা করিয়া শুষ্ক মরুভূমিবৎ স্থান সমূহকেও পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উর্বর ও ঐশ্বর্যশালী প্রদেশে পরিণত করিয়াছিল, তাহার প্রমাণ এখনও আছে।......