পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
২৮১

 “যাঁহারা নিরপেক্ষ ও ধীর ভাবে ভারতের বর্তমান জনহিতকর কার্যাবলী পরীক্ষা করিবেন, তাঁহারাই স্বীকার করিতে বাধ্য হইবেন যে, ভারতের লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষে পাঠান ফিরোজের ৩৯ বৎসরের শাসনকাল, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর এক শতাব্দী ব্যাপী শাসনকাল অপেক্ষা অধিকতর কল্যাণকর ছিল। এই এক শতাব্দীকাল বলিতে গেলে ভারতের পক্ষে সম্পূর্ণ অপব্যয় স্বরূপ হইয়াছে।”—১৯২৯, ১৫ই জুনের ‘ওয়েল ফেয়ারে’, বি. ডি. বসু কর্তৃক উদ্ধৃত।

 একখানি সরকারী দলিলে লিখিত আছে:—

 “সুলতান অত্যন্ত জলাভাব দেখিয়া মহানুভবতার সঙ্গে হিসার ফিরোজা এবং ফতেবাদ সহরে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করিবার সঙ্কল্প করিলেন। তিনি যমুনা ও শতদ্রু এই দুই নদী হইতে দুইটি জল প্রবাহ সহরে আনিলেন। যমুনাগত জল প্রবাহের নাম রাজিওয়া, অন্যটির আলগখানি। এই দুইটি জল প্রবাহই কর্ণালের নিকট দিয়া আসিয়াছিল এবং ৮০ ক্লোশ চলিবার পর একটি খাল দিয়া হিসার সহরে জল যোগাইয়াছিল।... ইহার পূর্বে চৈত্রের ফসল নষ্ট হইত, কেন না জল ব্যতীত গম জন্মিতে পারে না। খাল কাটিবার পর, ফসল ভাল হইতে লাগিল। ... আরও বহু জলপ্রবাহ এই সহরে আনিবার ব্যবস্থা হইল এবং ফলে এই অঞ্চলের ৮০।৯০ ক্রোশ ব্যাপী স্থান কর্ষণযোগ্য হইয়া উঠিল।[]

 “রোটক খালের উৎপত্তি এইরূপে হইয়াছিল। ১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে হিসার ফিরোজা (ফিরোজাবাদ) হইতে দিল্লী সহর পর্যন্ত জলসেচের জন্য একটি খাল খনন করা হয়। আলিমর্দান খাঁ আড়াই শত বৎসর পূর্বে তৈরী এই খালের সাহায্য যতদূর সম্ভব লইয়াছিলেন এবং তাহা হইতে নূতন খাল কাটিয়াছিলেন।”—Rohtak District Gazetteer, 1884, p. 3.

 এই সমস্ত কথা এখন উপন্যাস বলিয়াই মনে হয়। আমাদের সভ্য গবর্ণমেণ্ট কুপার্স হিল কলেজে এবং পরবর্তী কালে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারদের গর্ব করিয়া থাকেন,—কিন্তু তৎসত্ত্বেও ১৪শ শতাব্দীর মুসলমান শাসকদের নিকট হইতে তাঁহাদের অনেক কিছু শিখিবার আছে।

 জলসেচের এই অবস্থা! কিন্তু এই অভিশপ্ত জেলার (বাঁকুড়ার) দুঃখ দুর্দশা, আরও নানা কারণে এখন চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে। রেশমের গুটী হইতে সূতাকাটা এবং বস্ত্রবয়ন এই জেলার একটি প্রধান শিল্প ছিল। সহস্র সহস্র লোক এই বৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিত। পিতল ও কাঁসার শিল্পের দ্বারাও বহু সহস্র লোকের (কাঁসারীদের) অন্ন সংস্থান হইত। কিন্তু এই দুই শিল্পই এখন ধ্বংসোন্মুখ।

 রেশম বস্ত্রের শিল্পই বোধহয় বাঁকুড়ার সর্বাপেক্ষা প্রধান শিল্প। শত শত পরিবার ইহার উপর নির্ভর করিয়া থাকে। বিষ্ণুপুর, সোনামুখী এবং বীরসিংহের তাঁতিরা, লাল, হলদে, নীল, বেগ্‌নি, সবুজ রঙের রেশমের শাড়ী এবং বিবাহের জন্য রেশমের ‘জোড়’ তৈরী করিয়া থাকে। স্থানীয় মহাজনেরা এই সব রেশমের কাপড় ভারতের নানা স্থানে রপ্তানী করিয়া থাকে। এদেশে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা বিবাহ উপলক্ষে এই সব রেশমের শাড়ী ও জোড় বহুল পরিমাণে ব্যবহার করিয়া থাকে। পাঁচ ছয় বৎসর পূর্বেও,


  1. “লম্বার্ডি প্রদেশে গ্রীষ্মকালে নিম্ন আল্প্‌স পর্বতের বাহিরে জলাভাব ঘটে, কিন্তু মধ্য যুগ হইতে এখানে এমন চমৎকার জলসেচের ব্যবস্থা আছে, যাহা ইয়োরোপের কুত্রাপি নাই। সুতরাং এখানে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।”