প্রত্যেক তাঁতিপরিবার তাঁত পিছু দৈনিক দুই টাকা হইতে তিন টাকা পর্যন্ত রোজগার করিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রদর্শনী হইবার কয়েক মাস পর হইতেই বিষ্ণুপুরের রেশমের কাপড়ের মূল্য হ্রাস হইতে থাকে। রেশমের সূতা, জরী প্রভৃতি কাঁচা মালের মূল্য পূর্ববৎই থাকে। রেশমের কাপড়ের মূল্য কমিতে কমিতে এতদূর নামিয়া আসিয়াছে যে, তাঁতিরা অনেকস্থলে বাধ্য হইয়া কাপড় বোনা ছাড়িয়া দিয়াছে।
“দেশের প্রধান ব্যক্তিগণ বা গবর্ণমেণ্ট এ পর্যন্ত এই দূরবস্থার কারণ নির্ণয় করিতে চেষ্টা করেন নাই। বিষ্ণুপুর শিল্পপ্রধান সহর। এ স্থানের অধিকাংশ লোক তন্তুবায়, কর্মকার বা শাঁখারী। এই তাঁতিদের এবং কামারদের অত্যন্ত দুর্দশা হইয়াছে।
“পিতল শিল্পের বাজার অত্যন্ত মন্দা। বিদেশ হইতে অ্যালুমিনিয়াম ও এনামেলের বাসন আমদানীর ফলে এই শিল্পের অবনতি হইয়াছে; এই শিল্পের পুনরুদ্ধারের আশা নাই।
“প্রাচীন বিষ্ণুপুর সহরের দুইটি প্রধান শিল্প এইভাবে নষ্ট হওয়াতে, এই স্থানের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়াছে এবং শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা বিষ্ণুপুর ত্যাগ করিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইতেছে। বিষ্ণুপুর সহরের শতকরা ৭০ জন লোক এজন্য দুর্গতিগ্রস্ত হইয়াছে।”[১]
(২) ফরিদপুর—বাংলায় খাদ্যাভাব
আমি উপরে যে জেলার অবস্থা বর্ণনা করিয়াছি, তাহা বর্ষাকাল ব্যতীত অন্য সময়ে শুষ্ক ও জলহীন, এবং অনেক সময়ে বৃষ্টিও ঐ অঞ্চলে ভাল হয় না। পক্ষান্তরে অন্য একটি জেলার কথা বলিব, যাহা গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত এবং প্রকৃতি যাহার উপর সদয়। এখানে বর্ষার সময়ে জমির উপর পলিমাটী পড়িয়া তাহার উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে। আরও একটি কারণে, এই জেলার কথা বলিতেছি;—আমি কয়েকবার এই জেলায় ভ্রমণ করিয়াছি, এবং লোকের প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিবার সুযোগ পাইয়াছি। একটা প্রধান কথা মনে রাখিতে হইবে,—বাংলার সর্বত্র কৃষিজাত দ্রব্যই আয়ের একমাত্র পথ,—১৮৭০ সালের কোঠা পর্যন্ত যে সমস্ত আনুষঙ্গিক বৃত্তি সহস্র সহস্র লোক অবলম্বন করিয়া বাঁচিত, তাহা সর্বত্রই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বয়নশিল্প দ্রুত লোপ পাইতেছে,—পূর্বে নদীতে মাল ও যাত্রী বহনের জন্য যে সব বড় বড় নৌকা চলিত, বিদেশী কোম্পানীর জাহাজ তাহার স্থান অধিকার করিয়াছে। যে সব তাঁতি, জোলা ও মাঝি মাল্লাদের মুখের অন্ন কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে, তাহারা সকলে এখন কৃষিবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে। ফলে জমির উপর অতিরিক্ত চাপ পড়িয়াছে।[২]
- ↑ অমৃত বাজার পত্রিকা—৫ই জুলাই, ১৯২৮ তারিখে প্রকাশিত পত্র দ্রষ্টব্য।
- ↑ “বয়নশিল্প বাংলার একটা বড় শিল্প ছিল, বিদেশী কাপড়ের আমদানী ঐ শিল্প নষ্ট হইবার অন্যতম কারণ”।—Jack: The Economic Life of a Bengal District.
“এই জেলায় পদ্মা, মেঘনা, মধুমতী প্রভৃতি বড় বড় নদীতে ষ্টীমার চলাচল করে, জেলার অভ্যন্তরে আরও অনেক নদীতে ষ্টীমার যায়।”—O’ Malley; Faridpore (1925)
“মাছ ধরিয়া প্রায় ৪৭ হাজার লোক জীবিকা নির্বাহ করে, যাহারা মাছ ধরে ও যাহারা উহা বিক্রয় করে, তাহারা সকলেই এই শ্রেণীর অন্তর্গত ...... জেলার প্রধান ব্যবসা—কৃষিজাত পণ্য লইয়া।”—O’ Malley.