কেরাণী বা উকীলও কিছু পয়সা উপার্জন করে, কিন্তু তাহারা সাধারণতঃ গ্রামের অধিবাসী নহে। পক্ষান্তরে, বড় বড় জমিদারীর মালিকেরা তাঁহাদের জমিদারীতে বাস করেন না এবং তাঁহাদের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা গ্রাম হইতে শোষণ করিয়া কলিকাতায় চালান হয়।[১] ইহাও বিবেচ্য যে, প্রধান খাদ্যশস্য সম্বন্ধে ফরিদপুর জেলা আত্মনির্ভরক্ষম নহে। কেবলমাত্র ইহাই তত বেশী চিন্তার কারণ নহে। বস্তুতঃ, পাট উৎপাদনকারী জেলাগুলির পক্ষে ইহাকে সুলক্ষণও বলা যাইতে পারে, কেননা তাহারা তাহাদের বাড়তি টাকা দিয়া বাখরগঞ্জ, খুলনা প্রভৃতি জেলা হইতে চাউল কিনিতে পারে। কিন্তু যদি আমরা সমগ্র বাংলার মোট উৎপন্ন চাউলের হিসাব করি, তাহা হইলে স্তম্ভিত হইতে হয়। কেন-না যে বাংলা ভারতের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যশালী প্রদেশ বলিয়া পরিচিত, সেখানে উৎপন্ন খাদ্য শস্যের পরিমাণ সমগ্র লোক সংখ্যার পক্ষে যথেষ্ট নহে। বাংলাদেশে মোট উৎপন্ন চাউলের পরিমাণ ২৭,৭৩,৭৬,৭০২ মণ। দুর্ভিক্ষ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে মাথা পিছু বার্ষিক ৭ মণ চাউল প্রয়োজন হয়। বাংলার লোকসংখ্যা ৪,৫৭,৯১,৬৮৯। সুতরাং বাংলার পক্ষে বার্ষিক ৩২,০৫,৪১,৮২৩ মণ চাউলের প্রয়োজন। অতএব বাংলাদেশে মোট ৪,৩১,৬৫,১২১ মণ চাউল কম পড়ে—অর্থাৎ মাথা পিছু বার্ষিক প্রায় এক মণ—অর্থাৎ মাথা পিছু দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ ৩/৪ সের।[২]
বাংলার একটি অন্যতম উর্বর জেলার অধিবাসীদের মাথা পিছু আয় এত কম, একথা আশ্চর্য মনে হইতে পারে। ইহার কারণ, লোক বসতির ঘনতা; এখানে প্রতি বর্গ মাইলে লোকসংখ্যা গড়ে ১৪৯ জন। হাওড়া (প্রতি বর্গ মাইলে ১,৮৮২ জন), ঢাকা (প্রতি বর্গ
- ↑ সমস্ত বড় জমিদারীই কলিকাতাবাসী জমিদারদের অধিকৃত। নিম্নে কতকগুলি বড় জমিদারীর তালিকা দেওয়া হইল:—তেলিহাটী আমিরাবাদ—৭২,০০০ একর; হাভেলী—৬০,৯০০ একর; কোটালীপাড়া—৩৪,৬০০ একর; ইদিলপুরে—৩৩,২০০ একর। (২য় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)
- ↑ এই সব তথ্য কৃষিবিভাগ হইতে প্রকাশিত রিপোর্ট হইতে গৃহীত। প্রত্যেক জেলার উৎপন্ন ধান্যের হিসাব ধরিয়া মোট উৎপন্নের পরিমাণ ঠিক করা হইয়াছে। এই সব তথ্য হইতে লতিফের মন্তব্য সত্য বলিয়া প্রমাণিত হয়—“বাংলাদেশে মোট উৎপন্ন চাউল, সমগ্ন অধিবাসীদের প্রয়োজন মিটাইতে পারে না।” (Economic Aspect of the Indian Rice Export Trade, 1923.) লতিফের হিসাব মতে, ভারতের অধিবাসীদের জন্য মোট ৩ কোটী ৩৫.১ লক্ষ টন চাউলের প্রয়োজন হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উৎপন্ন হয় ৩ কোটী ২০.২ লক্ষ টন চাউল। সুতরাং ১৫.৫ লক্ষ টন চাউলের ঘাটতি পড়ে। “অতএব দেখা যাইতেছে যে, বর্মা চাউল আমদানী না হইলে পরিণাম অতি শোচনীয় হইত।”
পানাণ্ডিকর বলেন—“দেখা গিয়াছে যে, পুরুষের পক্ষে দৈনিক আধ সের এবং স্ত্রীলোক বা বালক বালিকাদের পক্ষে তার চেয়ে কিছু কম চাউল হইলেই অনাহারে মৃত্যু নিবারণ করা যায়। .... কিন্তু এই পরিমাণ চাউল কোন পরিবারের লোকদের শরীরের পুষ্টি ও বলের পক্ষে যথেষ্ট নহে।”
ব্যানার্জী (Fiscal Policy in India) বলেন,—“স্বাভাবিক অবস্থায় দেশে যে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়, তদ্বারা সমস্ত অভাব মিটাইয়া বিদেশে রপ্তানী করিবার মত কিছু উদ্বৃত্ত থাকে কিনা সন্দেহ। বিশেষজ্ঞেরা বলেন যে, ভারতে যে মোট খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়, তাহা ভারতবাসীদের পক্ষে পর্যাপ্ত নহে এবং যদি প্রত্যেক লোককেই উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য দেওয়া যাইত, তবে ভারতকে খাদ্যশস্য আমদানী করিতে হইত, সে উহা রপ্তানী করিতে পারিত না।”
“ভারতে উৎপন্ন খাদ্যশস্যের পরিমাণ ৪ কোটী ৮৭ লক্ষ টন, কিন্তু ভারতের পক্ষে ৮ কোটী ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্যের প্রয়োজন। সুতরাং তাহার খাদ্যশস্য শতকরা ৪০ ভাগ কম পড়ে। ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, ভারতবাসীরা পর্যাপ্ত খাদ্য পায় না।”—C. N. Zutshi, Modern Review, Sept., 1927.
সুতরাং এ বিষয়ে যাঁহারা আলোচনা ও চিন্তা করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলেরই মত এই যে—কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে খাদ্যশস্যের ঘাটতি পড়ে।