১৭৪০—৫০ খৃঃ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রীয়েরা বাংলাদেশ হইতে যে ধন সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং চৌথ আদায় করিয়াছিল, তাহার পরিমাণ কয়েক কোটী টাকা হইবে। সৈয়র মুতাখেরিনের মতে, প্রথম মারাঠা অভিযানের সময়ে মুর্শিদাবাদ সহরের চারিদিকে প্রাচীর ছিল না। সেই সময়ে মীর হাবিব এক দল অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া আলিবর্দী খাঁর আগমনের পূর্বেই মুর্শিদাবাদ সহর আক্রমণ করেন এবং জগৎশেঠের বাড়ী হইতে দুই কোটী টাকার আর্কট মুদ্রা লইয়া যান। কিন্তু এই বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের ফলেও জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের কিছুমাত্র সম্পদ ক্ষয় হয় না। তাঁহারা পূর্বের মতই সরকারকে এক এক বার এক কোটী টাকার হুণ্ডী বা ‘দর্শনী’ দিতে থাকিতেন।
বাংলার ইতিহাসের যুগসন্ধি পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে,—লুণ্ঠন, শোষণ প্রভৃতি আকস্মিক বা সাময়িক ছিল এবং লোকে তাহার কুফল হইতে শীঘ্রই সারিয়া উঠিতে পারিত। কিন্তু বর্তমানে এই প্রদেশ ক্রমাগত যে ভাবে শোষিত হইতেছে, তাহা উহাকে একেবারে নিঃস্ব করিয়া ফেলিয়াছে। উহা হইতে উদ্ধার লাভের তাহার উপায় নাই। পলাশীর যুদ্ধের পর, ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা আসিয়া পড়িল এবং রোমের প্রিটোরিয়ান গার্ডদের মত তাঁহারাও মুর্শিদাবাদের মসনদ নীলামে সর্বোচ্চ দরে বিক্রয় করিলেন। হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির তৃতীয় রিপোর্ট অনুসারে (১৭৭৩) দেখা যায় যে, ১৭৫৭—১৭৬৫ সাল পর্যন্ত বাংলার “ওয়ারউইকেরা” বাংলার মসনদে নূতন নূতন নবাবকে বসাইয়া ৫।৬ কোটী টাকার কম উপার্জন করেন নাই। এই বিপুল অর্থের অধিকাংশই কোন না কোন আকারে ইংলণ্ডে প্রেরিত হইয়াছিল।[১]
কিন্তু পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার তুলনায় ইহা অতি সামান্য অনিষ্ট করিয়াছে। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লীর নামমাত্রে পর্যবসিত সম্রাটের নিকট হইতে দেওয়ানী পাইয়া, কোম্পানী—আইনতঃ ও কার্যতঃ—বাংলার শাসন কর্তা হইয়া বসিলেন। বাংলার মোট রাজস্ব হইতে মোগল সম্রাটের কর (২৬ লক্ষ টাকা), নবাবের ভাতা এবং আদায় খরচা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিত, তাহা মূলধন রূপে খাটানো হইত।
ইষ্টি ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ষ্টক হোল্ডারগণ এমন কি ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টও বাংলার রাজস্বের ভাগ দাবী করিতে লাগিলেন। এই উদ্বৃত্ত অর্থের অধিকাংশ দ্বারাই পণ্য ক্রয় করিয়া রপ্তানী করা হইতে লাগিল, কিন্তু তাহার পরিবর্তে বাংলার কিছুই লাভ হইত না।
একটি দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা পরিষ্কার হইবে। ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দেও, “রাজস্ব আদায় করা কালেক্টরের প্রধান কর্তব্য ছিল এবং উহার সাফল্যের উপরই তাঁহার নাম নির্ভর করিত, তাঁহার শাসনের আমলে প্রজাদের অবস্থা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না” (হাণ্টার)। বীরভূম ও বিষ্ণুপর এই দুই জেলার নিট রাজস্ব এক লক্ষ পাউণ্ডেরও বেশী হইত, এবং গবর্ণমেণ্টের শাসন ব্যয় ৫ হাজার পাউণ্ডের বেশী হইত না। অবশিষ্ট ৯৫ হাজার পাউণ্ডের কিয়দংশ কলিকাতা বা অন্যান্য স্থানের তোষাখানায় পাঠানো হইত এবং কিয়দংশ জেলায় জেলায় কোম্পানীর কারবার চালাইবার জন্য ব্যয় করা হইত।
রাজস্বের উদ্ধৃত্তাংশ মূলধন রূপে (ইনভেস্টমেণ্ট) খাটানোর কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ব্যাপারটা কি এবং তাহার পরিণামই বা কিরূপ হইয়াছিল তাহা হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট কমিটির ৯ম রিপোর্টে (১৭৮৩) বিশদরূপে বর্ণনা করা হইয়াছে:—
“বাংলার রাজস্বের কিয়দংশ বিলাতে রপ্তানী করিবার উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করিবার জন্য পৃথক ভাবে রাখা হইত এবং ইহাকেই ‘ইনভেষ্টমেণ্ট’ বলিত। এই ‘ইনভেস্টমেণ্ট’এর
- ↑ সিংহ—Economic Annals.