পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
২৮৯

পরিমাণের উপরে কোম্পানীর প্রধান কর্মচারীদের যোগ্যতা নির্ভর করিত। ভারতের দারিদ্র্যের ইহাই ছিল প্রধান কারণ, অথচ ইহাকেই তাহার ঐশ্বর্ষের লক্ষণ বলিয়া মনে করা হইত। অসংখ্য বাণিজ্য পোত ভারতের মূল্যবান পণ্যসম্ভারে পূর্ণ হইয়া প্রতি বৎসর ইংলণ্ডে আসিত এবং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে ঐ ঐশ্বর্যের দৃশ্য প্রদর্শিত হইত। লোকে মনে করিত, যে দেশ হইতে এমন সব মূল্যবান, পণ্যসম্ভার রপ্তানী হইয়া আসিতে পারে, তাহা না জানি কতই ঐশ্বর্যশালী ও সেখানকার অধিবাসীরা কত সুখী! এই রপ্তানী পণ্যের দ্বারা এরূপও মনে হইতে পারিত যে, প্রতিদানে ইংলণ্ড হইতেও পণ্য সম্ভার ভারতে রপ্তানী হয় এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের মূলধন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইহা প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যসম্ভার নয়, ভারতের পক্ষ হইতে প্রভু ইংলণ্ডকে দেয় বার্ষিক কর মাত্র, এবং তাহাই লোকের মনে ঐশ্বর্যের মিথ্যা মায়া সৃষ্টি করিত।”

 বাংলার ঐশ্বর্য সরাসরি বিলাতে যাইত অথবা অন্য উপায়ে পরোক্ষভাবে বিলাতে পৌছিত,—উহার ফল বাংলার পক্ষে একই প্রকার। হাণ্টার বলেন:—

 “ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী ব্যবসাদার হিসাবে প্রতি বৎসর প্রায় ২ ১/২ লক্ষ পাউণ্ড বাংলা হইতে চীনে লইত; মাদ্রাজ তাহার মূলধনের জন্য বাংলা হইতে অর্থ সংগ্রহ করিত; এবং বোম্বাই তাহার শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না, বাংলা হইতেই ঐ ব্যয় যোগাইতে হইত। কাউন্সিল সর্বদা এই অভিযোগ করিতেন যে, একদিকে অন্তর্বাণিজ্য চালাইবার মত মুদ্রা দেশে থাকিত না, অন্যদিকে দেশ হইতে ক্রমাগত অজস্র রৌপ্য বাহিরে রপ্তানী হইত।”

 ১৭৮০ খৃঃ প্রধান সেনাপতি স্যার আয়ার কুট সপরিষদ গবর্ণর জেনারেলকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেন:—

 “মাদ্রাজের ধনভাণ্ডার শূন্য, অথচ ফোর্ট সেণ্ট জর্জের ব্যয়ের জন্য মাসিক ৭ লক্ষ টাকার বেশী আশু প্রয়োজন। ইহার প্রত্যেক কড়ি বাংলা হইতে সংগ্রহ করিতে হইবে, অন্য কোন স্থান হইতে এক পয়সাও পাইবার সম্ভাবনা আমি দেখিতেছি না।”

 ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে প্রধান সেনাপতি বিলাতের ‘ইণ্ডিয়া হাউসে’ লিখেন,—“রাজ্যের অধিবাসী ও সৈন্য সকলকেই প্রধানতঃ বাংলার অর্থেই পোষণ করিতে হইতেছে।”

 হাণ্টার লিখিয়াছেন—“মারাঠা যুদ্ধ চালাইবার জন্য কলিকাতার ধনভাণ্ডার শূন্য করা হইয়াছিল।......১৭৯০ খৃষ্টাব্দের শেষে টিপু সলতানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোম্পানীর ধনভাণ্ডার শোষিত হইয়াছিল।”

 লর্ড ওয়েলেস্‌লি মারাঠাদের সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং তাহার ফলে শেষ পর্যন্ত মারাঠা শক্তি ধ্বংস হইয়াছিল। কিন্তু এই যুদ্ধের ব্যয় বাংলাকেই যোগাইতে হইয়াছিল। স্মরণাতীত কাল হইতে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাই ছিল ভারতের মহাজন।

(২) পলাশী শোষণ

 এই অধ্যায়ের প্রথমে দিল্লী কর্তৃক বাংলার ধনশোষণের কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু এই শোষণের সহিত ‘পলাশী শোষণ’ রূপে যাহা পরিচিত, তাহার যথেষ্ট প্রভেদ আছে; যে আর্থিক শোষণের ফলে বাংলার ধন ক্রমাগত ইংলণ্ডে চলিয়া যাইতেছে, তাহারই নাম ‘পলাশী শোষণ’।

 “১৭০৮ খৃঃ—১৭৫৬ খৃঃ পর্যন্ত বাংলায় ইংরাজ কোম্পানীর আমদানী পণ্যের শতকরা ৭৪ ভাগই ছিল স্বর্ণ এবং ইহার পরিমাণ ছিল ৬৪,০৬,০২৩ পাউণ্ড। ইংরাজ কোম্পানীর