কথা ছাড়িয়া দিলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয়ই বেশ উন্নতিশীল ছিল। হিন্দু, আর্মানী এবং মুসলমান বণিকেরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এবং আরব, তুরস্ক ও পারস্যের সঙ্গে প্রভূত পরিমাণে ব্যবসা চালাইত।” (সিংহ)
ইহার পর, ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে এডমাণ্ড বার্ক, ফক্সের ‘ইষ্ট ইণ্ডিয়া বিলের’ আলোচনাকালে, একটি স্মরণীয় বক্তৃতা করেন। ‘পলাশী শোষণের’ ফলে ভারতের (কার্যতঃ বাংলার) ধন কিরূপে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছিল, এই বক্তৃতায় তিনি তাহার জ্বলন্ত চিত্র অঙ্কিত করেন:—
“এশিয়ার বিজেতাদের হিংস্রতা শীঘ্রই শান্ত হইত, কেননা তাহারা বিজিত দেশেরই অধিবাসী হইয়া পড়িত। এই দেশের উন্নতি বা অবনতির সঙ্গে তাহাদের ভাগ্যসূত্র গ্রথিত হইত। পিতারা ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য আশা সঞ্চয় করিত, সন্তানেরাও পূর্বে পুরুষগণের স্মৃতি বহন করিত। তাহাদের অদৃষ্ট সেই দেশের সঙ্গেই জড়িত হইত এবং উহা যাহাতে বাসযোগ্য বরণীয় দেশ হয়, সেজন্য তাহারা চেষ্টার ত্রুটি করিত না। দারিদ্র্য, ধ্বংস ও রিক্ততা—মানুষের পক্ষে প্রীতিকর নয় এবং সমগ্র জাতির অভিশাপের মধ্যে জীবন যাপন করিতে পারে, এরূপ লোক বিরল। তাতার শাসকেরা যদি লোভ বা হিংসার বশবর্তী হইয়া অত্যাচার, লুণ্ঠন প্রভৃতি করিত, তাহা হইলে তাহার কুফলও তাহাদের ভোগ করিতে হইত। অত্যাচার উপদ্রব করিয়া ধন সঞ্চয় করিলেও তাহা তাহাদের পারিবারিক সম্পত্তিই হইত এবং তাহাদেরই মুক্তহস্তে ব্যয় করিবার ফলে অথবা অন্য কাহারও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য ঐ ধন প্রজাদের হাতেই পুনরায় ফিরিয়া যাইত। শাসকদের স্বেচ্ছাচার, সর্বদা অশান্তি প্রভৃতি সত্ত্বেও, দেশের ধন উৎপাদনের উৎস শুকাইয়া যাইত না, সুতরাং ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রভৃতির উন্নতিই দেখা যাইত। লোভ ও কার্পণ্যও একদিক দিয়া জাতীয় সম্পদকে রক্ষা করিত ও তাহাকে কাজে খাটাইত। কৃষক ও শিল্পীদের ঋণের জন্য উচ্চ হারে সুদ দিতে হইত, কিন্তু তাহার ফলে মহাজনদের ঐশ্বর্য-ই বর্দ্ধিত হইত এবং কৃষক ও শিল্পীরা পুনর্বার ঐ ভাণ্ডার হইতে ঋণ করিতে পারিত। তাহাদিগকে উচ্চ মূল্যে মূলধন সংগ্রহ করিতে হইত, কিন্তু উহার প্রাপ্তি সম্বন্ধে তাহাদের মনে কোন সংশয় থাকিত না এবং এই সকলের ফলে দেশের আর্থিক অবস্থাও মোটের উপর উন্নত হইত।
“কিন্তু ইংরাজ গবর্ণমেণ্টের আমলে ঐ সমস্তই উল্টাইয়া গিয়াছে। তাতার অভিযান অনিষ্টকর ছিল বটে, কিন্তু আমাদের ‘রক্ষণাবেক্ষণই’ ভারতকে ধ্বংস করিতেছে। তাহাদের শত্রুতা ভারতের ক্ষতি করিয়াছিল আর আমাদের বন্ধুতা তাহার ক্ষতি করিতেছে। ভারতে আমাদের বিজয়—এই ২০ বৎসর পরেও (আমি বলিতে পারি ১৭৫ বৎসর পরেও—গ্রন্থকার) সেই প্রথম দিনের মতই বর্বরভাবাপন্ন আছে। ভারতবাসীরা পক্ককেশ প্রবীণ ইংরাজদের কদাচিৎ দেখিয়া থাকে; তরুণ যুবক বা বালকেরা ভারতবাসীদের শাসন করে; ভারতবাসীদের সঙ্গে তাহারা সামাজিকভাবে মিশে না, তাহাদের প্রতি কোন সহানভূতির ভাবও উহাদের নাই। ঐ সব ইংরাজ যুবক ইংলণ্ডে থাকিলে যে ভাবে বাস করিত, ভারতেও সেইভাবে বাস করে। ভারতবাসীদের সঙ্গে যেটুকু তাহারা মিশে, সে কেবল রাতারাতি বড়মানুষ হইবার জন্য। তাহারা যুবকসুলভ দুর্নিবার লোভ ও প্রবৃত্তির বশবর্তী হইয়া এক দলের পর আর এক দল ভারতে যায়, এবং ভারতবাসীরা এই সব সামরিক অভিযানকারী ও সুবিধাবাদীদের দিকে হতাশনেত্রে চাহিয়া থাকে। এক দিকে ভারতের ধন যতই ক্ষয় হইতেছে, অন্য দিকে এই সব যুবকদের লোভ ততই বাড়িয়া চলিয়াছে। ইংরাজদের লাভের প্রত্যেকটি টাকা, ভারতের সম্পদকে ক্ষয় করিতেছে।”
কোম্পানীর কর্মচারীরা ভারত হইতে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিত এবং বিলাতে ফিরিয়া অসদুপায়ে লব্ধ সেই ঐশ্বর্যে নবাবী করিত। তাহারা যতদূর সম্ভব জাঁকজমক ও