রাখিতে হইবে, ব্রহ্ম বিজয়ের প্রধান উদ্দেশ্য, ল্যাঙ্কাশায়ারের বস্ত্রজাত বিক্রয়ের বাজার তৈরী করা এবং ব্রহ্মের ঐশ্বর্যশালী বনভূমি, রত্নখনি ও তৈলের খনি। এই সমস্ত দিকে শোষণ কার্য প্রবল উৎসাহে চলিতেছে। এইরূপে ভারতের দরিদ্র প্রজারা ব্রহ্ম বিজয় এবং তাহার শাসনব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ যোগাইয়াছে, আর ব্রিটিশ ধনী ও ব্যবসায়ীরা উহার ফলে ঐশ্বর্যশালী হইয়াছে। কিছু দিন হইল, ব্রিটিশ শোষণকারীরা ব্রহ্মকে ভারত হইতে পৃথক করিবার জন্য এক আন্দোলন সৃষ্টি করিয়াছে। কতকগুলি নির্বোধ অদূরদর্শী ব্রহ্মবাসী গোটা কয়েক সরকারী চাকরীর প্রলোভনে তাহাদের আন্দোলনে যোগ দিয়াছে।[১]
(৩) মেষ্টনী ব্যবস্থার কল্যাণে বাংলার ধন শোষণ
মেষ্টনী ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তাহার রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ হইতেই বঞ্চিত হইতেছে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রাজস্ব জাতিগঠনমূলক কার্যের জন্য অবশিষ্ট থাকিতেছে। এই ব্যবস্থায়, বাংলাদেশের রাজস্বের প্রধান প্রধান দফাগুলি—বাণিজ্যশুল্ক, আয়কর, রেলওয়ে প্রভৃতি—তাহার হাতছাড়া হইয়াছে। বাণিজ্যশুল্কের আয় ১৯২১-২২ সালে ৩৪ কোটী টাকা ছিল, ১৯২৯—৩০ সালে উহার পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে প্রায় ৫০ কোটী টাকায়। আর রাজস্বের যে সমস্ত দফা সর্বাপেক্ষা অসন্তোষজনক এবং যাহাতে আয় বাড়িবারও বিশেষ সম্ভাবনা নাই, সেই গুলিই মন্ত্রীদের অধীনস্থ তথাকথিত ‘হস্তান্তরিত’ বিভাগগুলির জন্য রাখা হইয়াছে। ইহার ফলে দেশে মাদক ব্যবহার এবং মামলা মোকদ্দমা বৃদ্ধির সহিত সংসৃষ্ট আবগারী শুল্ক ও কোর্ট ফি প্রভৃতির দরুণ নিন্দা ও গ্লানি দেশীয় মন্ত্রীদেরই বহন করিতে হইতেছে।
ইতিপূর্বে দেখাইয়াছি যে, পলাশীর যুদ্ধের সময় হইতেই, বাংলা ভারতের কামধেনু স্বরূপ ছিল এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশ জয়ের জন্য সামরিক ব্যয় যোগাইয়া আসিয়াছে। নূতন শাসন সংস্কারের আমলে, মেষ্টনী ব্যবস্থার ফলে বাংলারই সর্বাপেক্ষা বেশী ক্ষতি হইয়াছে এবং ইহার অর্থ নির্মমভাবে শোষণ করা হইতেছে। আমি আরও দেখাইয়াছি যে, বাংলার আর্থিক দারিদ্র্য পলাশীর যুদ্ধের সময় হইতেই আরম্ভ হইয়াছে। মেষ্টনী ব্যবস্থা, অবস্থা আরও শোচনীয় করিয়াছে মাত্র।
বাংলার ভূতপূর্ব লেঃ গবর্ণর স্যার আলেকজাণ্ডার ম্যাকেঞ্জি ১৮৯৬ সালে ইম্পিরিয়াল বাজেট আলোচনার সময় বলেন,—“এই প্রদেশরূপী মেষকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার লোমগুলি নির্মূল করিয়া কাটিয়া লওয়া হইতেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় রোমোদ্গম না হয়, ততক্ষণ সে শীতে থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে।” (অবশ্য, রোমোদ্গম হইলেই পুনরায় উহা কাটিয়া লওয়া হয়।)
সুতরাং বাংলাদেশ ইম্পিরিয়াল গবর্ণমেণ্টের নিকট হইতে ক্রমাগত অবিচার সহ্য করিয়া আসিতেছে।
বাংলা ভারতের প্রধান পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ঐশ্বর্যশালী ও জন-বহুল, অথচ এই প্রদেশকেই সর্বাপেক্ষা কম টাকা দেওয়া হইতেছে! ফলে তাহার জাতিগঠনমূলক বিভাগগুলি সর্বদা অভাবগ্রস্ত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ শিক্ষার কথাই ধরা যাক। ১৯২৪—২৫
- ↑ এই পুস্তক যখন (১৯৩৭) ছাপা হইতেছে, তাহার পূর্বেই ব্রহ্ম-বিচ্ছেদ হইয়া গিয়াছে।