পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
২৯৭

 ঢাকার বস্ত্র ব্যবসায়ের উপরোক্ত বিবরণের পঞ্চম দফায় লিখিত হইয়াছে যে, হিন্দুরা স্বদেশের বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করিত। কিন্তু মোট ২৮ / লক্ষ টাকা মূল্যের বস্ত্রের মধ্যে, তাহারা মাত্র ২ লক্ষ টাকার বস্তু লইয়া কারবার করিত। অর্থাৎ চৌদ্দ ভাগের এক ভাগেরও কম বাণিজ্য হিন্দুদের ভাগে পড়িত। এই হিন্দুরাও আবার বাংলার লোক ছিল না।

 সকলেই জানেন, ব্যবসা বাণিজ্য এবং ব্যাঙ্কের কারবার ঘনিষ্ঠরূপে সংসৃষ্ট। ইয়োরোপে মধ্যযুগে, বিশেষতঃ ১৫শ, ১৬শ এবং ১৭শ শতাব্দীতে, ভিনিস, আমষ্টার্ডম, হামবার্গ, লণ্ডন প্রভৃতি সহরে—যেখানেই সমুদ্র বাণিজ্যের প্রসার ছিল, সেখানেই ‘রিয়াল্টো’ বা একশ্চেঞ্জ ব্যাঙ্ক থাকিত এবং ব্যবসায়ীরা ঐ সব স্থলে ভিড় জমাইত।

 বাঙালীরা ব্যবসায়ে উদাসীন ছিল বলিয়া উত্তর ভারতের লোকেরা তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া বাংলার সমস্ত ব্যাঙ্কের কারবার হস্তগত করিয়াছিল। ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্থানীগণ মুর্শিদাবাদের নিকটে ব্যাঙ্কিং এজেন্সি সমূহ স্থাপন করিয়াছিল।

 যথা,—“ইয়োরোপীয় প্রথায় ব্যাঙ্কের কাজ ভারতে আধুনিক কালে প্রচলিত হইয়াছে। ইয়োরোপীয়েরা আসিবার বহু পূর্বে সপরিচালিত স্বদেশী ব্যাঙ্ক সমূহ ছিল। প্রত্যেক রাজ দরবারেই রাজ ব্যাঙ্কার বা শেঠী থাকিত, অনেক সময় ইহাদের মন্ত্রীর ক্ষমতা দেওয়া হইত।”—[]

 অন্যত্র,—“এই সব হিন্দুদের আর্থিক ব্যাপারে বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল, কেননা, এই প্রদেশের বাণিজ্য প্রায় সম্পূর্ণরূপে বড় বড় বণিকদের হাতে ছিল এবং তাহাদের মধ্যে অনেকে উমিচাঁদ ও জগৎ শেঠদের ন্যায় উত্তর ভারত হইতে আগত। কোজা ওয়াজিদ ও আগা ম্যানুয়েলের ন্যায় অল্প সংখ্যক আর্মাণীরাও ছিল।”[]—S. C. Hill: Bengal in 1756—1757, Ch. I, Intro.

 সম্রাট ফরুক সিয়ারের সময়ে জগৎ শেঠেরা সাফল্য ও ঐশ্বর্যের উচ্চ শিখরে উঠিয়াছিলেন। মানিকচাঁদ নামক একজন জৈন বণিক এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা। মানিকচাঁদের ১৭৩২ সালে মৃত্যু হয়, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁহার কারবারের ভার ভ্রাতুষ্পুত্র ফতেচাঁদের হস্তে অর্পণ করিয়া যান। ১৭১৩ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার শাসক নিযুক্ত হইলে ফতেচাঁদ সরকারী ব্যাঙ্কার নিযুক্ত হন। তাঁহাকে “জগৎশেঠ” এই উপাধি দেওয়া হয়। ১৭৪৪ খৃষ্টাব্দে ফতেচাঁদ তাঁহার পৌত্রদ্বয় শেঠ মহাতাপ রায় ও মহারাজা স্বরূপচাঁদের হস্তে কারবারের ভার অর্পণ করিয়া পরলোক গমন করেন। এই দুই জন শেঠকে বাংলার রাষ্ট্র বিপ্লবের ইতিহাসের সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ ভাবে সংসৃষ্ট দেখিতে পাই। ইংরাজ লিখিত ইতিহাসে ফতেচাঁদের দুই পৌত্রের নাম পৃথকভাবে উল্লিখিত হয় নাই, তাঁহাদের উভয়কে “জগৎ শেঠ” অথবা “শেঠ” মাত্র এই নামে অভিহিত করা হইয়াছে। মুর্শিদাবাদে এই জগৎ শেঠের গদীর প্রভাব অসামান্য ছিল।


    জলবায়ু, অস্বাস্থ্যকর এবং আসামে ব্রাহ্মণ প্রাধান্য খুব বেশী ছিল।” A Raynal: A Philosophical and Political History of the settlements and Trade of the Europeans in the East and West India, vol. i, p. 144 (Ed-Lond. 1783).

  1. Sinha-Early European Banking in India.
  2. কোজা ওয়াজিদ আর্মানী ছিলেন না। ঐ বইয়েরই ৩০৪ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে—“নবাব মূর বণিক (মুসলমান) কোজা ওয়াজিদকে তাঁহার এজেণ্ট নিযুক্ত করিয়াছিলেন।”