“জগৎ শেঠ এক হিসাবে বাংলার নবাবের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তাঁহার ভাণ্ডারে প্রেরিত হয় এবং গবর্ণমেণ্ট প্রয়োজন মত জগৎ শেঠের উপরে চেক দেন,— যেমন ভাবে বণিকেরা ব্যাঙ্কের উপরে চেক দেন। আমি যতদূর জানি, শেঠেরা এই ব্যবসায়ে বৎসরে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা উপার্জন করেন।”
মহাতাপচাঁদের আমলে জগৎ শেঠের গদী ঐশ্বর্ষের চরম শিখরে উঠে। নবাব আলিবর্দী খাঁ জগৎ শেঠকে প্রভূত সম্মান করিতেন এবং ১৭৪৯ খৃষ্টাব্দে নবাবের সৈন্যদল যখন ইংরাজ বণিক ও আর্মাণী বণিকদের মধ্যে বিবাদের ফলে কাশিমবাজারে ইংরাজদের কুঠী ঘেরাও করে, সেই সময়ে ইংরেজরা জগৎ শেঠদের মারফৎ ১২ লক্ষ টাকা দিয়া নবাবকে সন্তুষ্ট করে। ইয়োরোপীয়দের পরিচালিত ব্যাঙ্ক তখনও এদেশে স্থাপিত হয় নাই এবং ইংরাজ ও অন্যান্য বিদেশী বণিকেরা শেঠদের নিকট হইতে টাকা ধার করিতেন। “তাঁহাদের (শেঠদের) এমন বিপুল ঐশ্বর্য ছিল যে, হিন্দুস্থান ও দাক্ষিণাত্যে তাঁহাদের মত ব্যাঙ্কার আর কখনও দেখা যায় নাই এবং তাঁহাদের সঙ্গে তুলনা হইতে পারে, সমগ্র ভারতে এমন কোন বণিক বা ব্যাঙ্কার ছিল না। ইহাও নিশ্চয় রূপে বলা যাইতে পারে যে, তাঁহাদের সময়ে বাংলাদেশে যে সব ব্যাঙ্কার ছিল, তাহারা তাঁহাদেরই শাখা অথবা পরিবারের লোক।” অবশ্য, সে সময়ে আরও ব্যাঙ্কার ছিল, যদিও তাহারা জগৎ শেঠদের মত ঐশ্বর্যশালী ছিল না। কোম্পানীর শাসনের প্রথম আমলে, মফঃস্বল হইতে মুর্শিদাবাদে, পরবর্তী কালে কলিকাতাতে—এই সব ব্যাঙ্কারদের মারফতই ভূমি রাজস্ব প্রেরণ করা হইত। ১৭৮০ সাল হইতে জগৎ শেঠদের গদীর অবনতি হইতে থাকে এবং ১৭৮২ সালে গোপাল দাস এবং হরিকিষণ দাস তাঁহাদের স্থানে গবর্ণমেণ্টের ব্যাঙ্কার নিযুক্ত হন।
এই সময়ের প্রতিপত্তিশালী ব্যাঙ্কারদের মধ্যে রামচাঁদ সা এবং গোপালচরণ সা ও রামকিষণ ও লক্ষ্মীনারায়ণের নাম শোনা যায়। আরও দেখা যায় যে, কলিকাতার প্রধান ব্যাঙ্কিং ফার্ম নন্দীরাম বৈদ্যনাথের গোমস্তা রামজী রাম ১৭৮৭ সালে কারেন্সী কমিটির সম্মুখে সাক্ষ্য দিতে গিয়া বলেন যে, তাঁহাদের ফার্মের প্রধান কারবার হুণ্ডী লইয়া ছিল এবং এই হুণ্ডী যোগে বিবিধ স্থান হইতে রাজস্ব প্রেরিত হইত। ১৭৮৮ সালে শাগোপাল দাস এবং মনোহর দাস[১] এবং কলিকাতার অন্যান্য ২৪ জন কুঠিয়াল (দেশীয় ব্যাঙ্কার), মোহরের উপর বাট্টা হ্রাস করিবার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপক পত্র লিখেন। Economic Annals of Bengal এর গ্রন্থকার এইভাবে বিষয়টি উপসংহার করিয়াছেন— “কুঠিয়ালদের নাম ও অন্যান্য লোকের স্বাক্ষর হইতে দেখা যায় যে, তাহারা সকলেই অবাঙালী ছিল। কলিকাতার বাঙালীদের তখন কোন ব্যাঙ্ক ছিল না। বাঙালী ব্যাঙ্কারেরা বোধ হয় পোদ্দার মাত্র ছিল।”
বাংলা দেশ ও উত্তর ভারতে দেশীয় ব্যাঙ্কের কারবার কিরূপ প্রসার লাভ করিয়াছিল, তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। রেলওয়ে হইবার পূর্বে, প্রায় ৭৫ বৎসর পূর্বে, আমার পিতামহ গয়া ও কাশীতে তীর্থ করিতে যান। সে সময়ে গরুর গাড়ী বা নৌকাতে যাইতে হইত, এবং সঙ্গে বেশী নগদ টাকা লওয়া নিরাপদ ছিল না। আমার পিতামহ বড়বাজারের একটি ব্যাঙ্কের গদীতে টাকা জমা রাখেন এবং সেখান হইতে উত্তর ভারতের ব্যাঙ্ক সমূহের উপর তাঁহাকে হণ্ডী দেওয়া হয়।
পূর্বেই বলিয়াছি যে, ব্যাঙ্ক ও ব্যবসা বাণিজ্য ঘনিষ্ঠভাবে সংসৃষ্ট। ১২৫ বৎসর পূর্বে, রামমোহন রায় যখন রংপরে সেরেস্তাদার ছিলেন, তখন তিনি ধর্ম সম্বন্ধীয় সমস্যা
- ↑ বড় বাজারে ‘মনোহর দাসের চক’ খুব সম্ভব ইঁহারই নাম হইতে হইয়াছে।