পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
২৯৯

আলোচনার জন্য সন্ধ্যাকালে সভা করিতেন। ঐ সব সভায় মাড়োয়ারী বণিকেরা যোগ দিত। []

 আসাম ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হইবার পূর্বেই মাড়োয়ারীরা ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থান সদিয়া পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেছিল। তার পর এক শতাব্দীরও বেশী অতীত হইয়াছে এবং বর্তমানে মাড়োয়ারীরা আসামের সর্বত্র নিজেদের ব্যবসায়, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি বিস্তার করিয়াছে। তাহারা ইয়োরোপীয় চা-বাগান গলিতেও মূলধন যোগাইতেছে, যদিও আসামীদের তাহারা টাকা দেয় না।[]

 দার্জিলিং, কালিম্পং,—[] সিকিম ও ভুটান সীমান্তে, মাড়োয়ারীরা পশম, মৃগনাভি, ঘি, এলাচি প্রভৃতির রপ্তানী ব্যবসা করে এবং লবণ, বস্ত্রজাত প্রভৃতি আমদানী করে। এই সব ব্যবসায়ে তাহাদের কয়েক কোটী টাকা খাটে, এবং এ ক্ষেত্রে তাহারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাঙালীরা এই ব্যবসায়ের ক্ষেত্র হইতে নিজেদের দোষে হঠিয়া গিয়াছে। মাড়োয়ারীরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও পল্লীর আর্থিক অবস্থার উপর কিরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলে তাহা পরিষ্কার বুঝা যাইবে। কর্মাটার ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ে ষ্টেশনের সন্নিকটে একটি হাট বা বাজার আছে। এখানকার সমস্ত আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্য মাড়োয়ারীদের হাতে। কর্মাটার হইতে প্রায় পাঁচ মাইল দূরে কারো নামক একটি স্থানে একবার আমি গিয়াছিলাম। এখানেও ২/১টি মাড়োয়ারী বণিক সমস্ত ব্যবসায় দখল করিয়া বসিয়া আছে, দেখিলাম। নিকটবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের টাকা ধার দিয়াও তাহারা বেশ দু’পয়সা উপার্জন করিতেছে।

 বাংলা দেশেও অবস্থা ঠিক ঐরূপ। উত্তর বঙ্গে বগুড়ার নিকটে তালোরাতে একজন মাড়োয়ারীই প্রধান চাউল ব্যবসায়ী। সে একটি চাউলের কল স্থাপন করিয়াছে। টাকা লগ্নীর কারবার করিয়াও সে প্রভূত উপার্জন করে। খুলনার দক্ষিণাংশে কপোতাক্ষী তীরে বড়দল গ্রাম। এখানে প্রতি সপ্তাহে হাট বসে এবং বহুল পরিমাণে আমদানী রপ্তানীর কাজ হয়। কিন্তু এখানকার সমস্ত বড় বড় গদীই মাড়োয়ারীদের। বাঁকুড়ার অন্তর্গত বিষ্ণুপুর তসর বস্ত্রের কেন্দ্র। কয়েক বৎসর পূর্বেও বাঙালীদের হাতে কাপড়ের ব্যবসা ছিল। কিন্তু উদ্যোগী মাড়োয়ারীরা এখন বাঙালীদের এই ব্যবসা হইতে বহিষ্কৃত করিয়াছে। মুর্শিদাবাদ ও মালদহের রেশম কাপড়ের ব্যবসাও মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া ব্যবসায়ীদের দাদনের টাকায় চলিতেছে। তাহারাই প্রধানতঃ এই রেশমের বস্ত্রজাত রপ্তানী করে।


  1. “প্রাপ্ত বিবরণ হইতে বুঝা যায়, রংপুরে থাকিবার সময়েই রামমোহন বন্ধুবর্গদের সঙ্গে মিলিত হইয়া ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করিতেন,—পৌত্তলিকতা তাঁহাদের বিশেষ আলোচ্য বিষয় ছিল। রংপর তখন জনবহুল সহর এবং একটি ব্যবসা কেন্দ্র ছিল—বহু, জৈন ধর্মাবলম্বী মাড়োয়ারী বণিক এখানে থাকিতেন; এই সব মাড়োয়ারীদের মধ্যে কেহ কেহ রামমোহনের সভায় যোগ দিতেন। মিঃ লিওনার্ড বলেন যে, তাঁহাদের জন্য রামমোহনকে ‘কল্পসূত্র’ ও অন্যান্য জৈন্য ধর্মের গ্রন্থ পড়িতে হইয়াছিল।”— Life and Letters of Ram Mohan Ray, London (1900) by Miss Collet.
  2. গেট সাহেবের “আসাম” গ্রন্থে আছে, “১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে আমরা দেখিতে পাই অধ্যবসায়ী মাড়োয়ারী বণিকেরা আসামে তাঁহাদের ব্যবসায় চালাইতেছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ সদিয়া পর্যন্ত যাইয়াও কারবার করিতেন। এই সময়ে গোয়ালপাড়া হইতে কলিকাতা আসিতে ২৫/৩০ দিন লাগিত এবং কলিকাতা হইতে গোয়ালপাড়া যাইতে ৮০ দিনেরও বেশী লাগিত।”
  3. কালিম্পংকে তিব্বতের “অন্তর্বন্দর” বলা হয়, কেননা তিব্বতের সমস্ত আমদানী ও রপ্তানী বাণিজ্য এই স্থানের ভিতর দিয়াই হয়। কালিম্পং এ অবশ্য কয়েকজন বাঙালী আছেন, কিন্তু তাঁহারা সকলেই সরকারী অফিসার, কেরাণী প্রভৃতি।