বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু বাংলার কৃষিজাত —চাল, পাট, তৈল-বীজ, ডাল প্রভৃতির ব্যবসায় মাড়োয়ারীদের হস্তগত। তাহারা চামড়ার ব্যবসাও অধিকার করিত, কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের বিরোধী বলিয়া এ কার্য তাহারা করে না। বাংলার আমদানী পণ্যজাত প্রধানতঃ মাড়োয়ারীদের হাতে। তাহারা—আমদানীকারক বড় বড় ইয়োরোপীয় সওদাগরদের ‘বেনিয়ান’ তো বটেই, তাহা ছাড়া, এই সম্পর্কে যত কিছু ছোট, বড়, ‘মধ্যবর্তী’ ব্যবসায়ীর কাজ তাহারাই করিয়া থাকে। কালক্রমে এখন (১৯৩৭) মাড়োয়ারীগণ বৃহৎ চর্মশালা (tannery) খুলিয়াছেন।
অবশ্য, স্বীকার করিতে হইবে যে, আমদানী ও রপ্তানী সম্পর্কীয় মধ্যবর্তী ব্যবসায়ের কাজে বহু বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানও নিযুক্ত আছে। তবে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমানদের এই ব্যবসায়ে কোন অংশ নাই। হিন্দুদের মধ্যে প্রধানতঃ তিলি, সাহা কাপালী জাতির লোকেরাই এই সব কাজ করে। কিন্তু ইহাদের মধ্যে অনেকে এখন জমিদার ও মহাজন হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তাহাদের ব্যবসা—বুদ্ধি ক্রমে লোপ পাইতেছে। যদিও তাহারা, উচ্চবর্ণীয় হিন্দু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্যদের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি লাভের জন্য উম্মত্ত হইয়া উঠে নাই, তবু অধ্যবসায়ী অবাঙালীদের দ্বারা পৈতৃক ব্যবসায় হইতে চ্যুত হইতেছে। মুসলমান যুবক ব্যবসায় ক্ষেত্রের এই প্রতিযোগিতায় আরও পশ্চাৎপদ। মুসলমান ব্যাপারী ও আড়তদার আছে বটে, কিন্তু তাহারা প্রায় সকলেই অশিক্ষিত নিম্নস্তরের লোক। হিন্দুদের গোচর্মের ব্যবসায়ের প্রতি একটা স্বাভাবিক ঘৃণার ভাব আছে, সুতরাং এই ব্যবসায় মুসলমানদেরই একচেটিয়া।[১] কিন্তু রপ্তানীকারক প্রায় সকলেই ইয়োরোপীয়।
(২) বহমুখী কর্মতৎপরতা ও অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের অভাবই
বাঙালীর ব্যর্থতার কারণ
ব্যবসায়ে বাঙালীদের অসহায় ভাব ও অক্ষমতা নিম্নলিখিত কয়েকটি দৃষ্টান্ত দ্বারা পরিস্ফুট হইবে। বরিশাল ও নোয়াখালী জেলায় সুপারির চাষ আছে, কিন্তু উৎপাদনকারীরা অলসের মত বসিয়া থাকে; এবং সুপারির বিস্তৃত ব্যবসায় মগ, চীনা, এবং গুজরাটীদের হাতে; তাহারা ইহাতে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে।[২]
- ↑ মুসলমান চামড়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও অধিকাংশ অবাঙালী মুসলমান।
- ↑ “রেঙ্গুন ও কলিকাতায় সুপারি রপ্তানীর ব্যবসা সমস্তই বর্মী, চীনা এবং বোম্বাইয়ের ব্যবসায়ীদের হাতে। তাহাদের সকলেরই এজেণ্ট পাতারহাটে আছে এবং তাহাদের বেতন মাসিক হাজার টাকা হইতে তদূর্দ্ধ। তাহারা সপরিবারে বাস করে এবং রপ্তানীর মরসুমে স্থানটি বর্মা সহরের মত বোধ হয়। ষ্টীমার ঘাটের অনতিদূরে এই সব ব্যবসায়ীদের এলাকা। সেখানে শত শত মণ সুপারি প্রত্যহ শুকানো হইতেছে এবং বস্তাবন্দী করিয়া রপ্তানীর জন্য প্রস্তুত করা হইতেছে। পূর্ব বঙ্গে পাটের ব্যবসায়ের ন্যায় এই সুপারির ব্যবসায়ও একটি প্রধান ব্যবসায়, কেননা ইহাতে বৎসরে প্রায় ৩০/ ৪০ লক্ষ টাকার কারবার হয়। কিন্তু কৃষকদের দুর্ভাগ্য ক্রমে এই ব্যবসায়ের সমস্ত লাভই মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের হাতেই যায়।”— The Bengal Co-operative Journal No. 3, January, 1927.
লেখক সুপারি ব্যবসায়ের মূল্য কম করিয়া বলিয়াছেন। জ্যাক তাঁহার “বাখরগঞ্জ” গ্রন্থে এই ব্যবসায়ের মূল্য ৭৫ লক্ষ টাকা হিসাব করিয়াছেন।
বাঙালীদের ঔদাসীন্য ও অক্ষমতার প্রসঙ্গে শিমুগার(মহীশূরের) আরাধ্য লিঙ্গায়েতদের কর্ম তৎপরতার উল্লেখ করা যাইতে পারে। সম্প্রতি আমি ভদ্রাবতী (শিমুগার একটি তালুক) লোহার কারখানা পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলাম।
আমি দেখিলাম, যদিও লিঙ্গায়েতরা সামাজিক মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, তথাপি তাহারা শস্য চালানী ও সুপারির ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করিতেছে।